
ধূমপান
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বে মানবজাতির জন্য দুটি বড়ো বিপদ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এর একটি হল সিফিলিস, আরেকটি হল তারচেয়ে ভয়াবহ- যা অনেক কঠিন রোগের কারণ। তা হলো তামাক বা ধূমপান। যদিও আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অধিবাসীরা সীমিত আকারে আগে থেকেই বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ধূমপানের চর্চা করত, তবে তামাক চাষ ও ধূমপানের বিশ্বায়ন ঘটে আমেরিকা থেকেই।
ষোলো শতকে ইউরোপীয়রা বিশ্বের বাকি অংশে তামাকের প্রবর্তন করে এবং এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সময়ের সাথে সাথে তামাকের চাষ, উৎপাদন এবং ব্যবহার বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হয়, যার ফলে তামাক শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং সিগারেট, সিগার এবং পাইপের মতো তামাকজাত দ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। কালে ধূমপান একটি সামাজিক অভ্যাস এবং সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠে। কিন্তু ২০ শতকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ধূমপানের সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য- ঝুঁকিগুলি প্রকাশ পেতে থাকে যার ফলে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা এবং ধূমপানের নিয়মকানুন চালু হতে থাকে। বর্তমানে ধূমপান সারা পৃথিবীতে একটি প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে স্বীকৃত; আর এজন্য বিশ্বব্যাপী ধূমপানের হার কমানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
২০২০ সালের হিসাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) দেয়া তথ্য অনুসারে বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড়শো কোটি মানুষ তামাক সেবন করে থাকে।
তামাকের বিবিধ ব্যবহার রয়েছে। সিগারেট বিড়ি ছাড়া আরও বিভিন্ন উপায়ে তামাকের ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন:
ধূমপান: তামাকপাতা পুড়িয়ে তার ধোঁয়াকে নি:শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করানোই ধূমপান। সিগারেট, সিগার, বিড়ি এবং পাইপ এধরণের পদ্ধতি। এগুলো প্রায়ই নিকোটিন আসক্তি এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে যুক্ত।
চিবানো: তামাকের এক টুকরো গাল এবং মাড়ির মধ্যে রেখে মাঝে মাঝে রস ও থুতু গিলে ফেলা হয়। তাছাড়া পানের সাথে জর্দ্দা হিসাবেও এটি বহুল ব্যবহৃত। এভাবে মুখের মধ্যে শোষণের মাধ্যমে নিকোটিন রক্তে মিশে যায়।
হুক্কা বা শিশা: হুক্কা বা শিশাতে পাইপের মাধ্যমে তামাক ধূমপান করা হয়। ধোঁয়া একটি পানি ভর্তি পাত্রের মধ্য দিয়ে টেনে শ্বাস নেয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে হুক্কা ধূমপান জনপ্রিয়। এ ছাড়া স্নাফ ও স্নাস পদ্ধতিতে ইউরোপে তামাকের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
ভেভ: এটি ইদানীং আবিস্কৃত ধূমপানের পদ্ধতি যাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে শ্বাসের মাধ্যমে নিকোটিন নেওয়া হয়। কোম্পানিগুলো কম বা নিয়ন্ত্রিত নিকোটিনের কথা বললেও গবেষণায় এটিও সমান ক্ষতিকর বলেই প্রমাণিত।
বাংলাদেশে ধূমপান:
ধূমপান একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এদেশে ধূমপান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, পৃথিবীতে প্রায় ১৪০ কোটি মানুষ ধূমপান করে, পুরুষদের মধ্যে এই হার বেশি। বাংলাদেশে ধূমপান একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান করে এবং এর ব্যবহার নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই প্রচলিত। সরকার জনস্বাস্থ্যের উপর তামাকের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বর্ধিত কর, সংবিধিবদ্ধ গ্রাফিক সতর্কতা এবং ধূমপান মুক্ত নীতি সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে।
বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধূমপানের প্রকোপ:
বাংলাদেশে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ১০ ভাগ শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা ধূমপান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ১৫ বছর বয়সের মধ্যে নিয়মিত ধূমপায়ী হয়ে ওঠে। পরিবারের পিতামাতা ও বড়দের ভূমিকা ও বন্ধুদেরকে এজন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশে নারীদের ধূমপান: বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও এটি একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা বলে স্বীকৃত। সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ২ ভাগ নারী ধূমপান করে।
ধূমপানের বিপদসমূহ:
ধূমপানের কোন উপকার আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই, তবে ক্ষতির তালিকা সুদীর্ঘ। অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ এই ধূমপান, যার মধ্যে কয়েকটি মারাত্মক হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হলো ফুসফুসের ক্যান্সার, যা বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্যান্সার-সম্পর্কিত মৃত্যুর জন্য দায়ী। ধূমপান মুখ, গলা, খাদ্যনালী, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, প্রস্টেট এবং কিডনি সহ অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে, যার ফলে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), এমফাইসেমা এবং ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস হয়। উপরন্তু, ধূমপান হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ এবং হাত-পায়ের রক্তনালীর ব্লক বা পেরিফেরাল ভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি প্রজনন তন্ত্রের রোগ তৈরি করে, যেমন বন্ধ্যাত্ব এবং গর্ভাবস্থায় জটিলতা। সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার বা পরোক্ষ ধূমপানও সমানভাবে ক্ষতিকারক, যা শ্বাসকষ্টের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং অধূমপায়ীদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের ত্রুটি, অকাল জন্ম, বাচ্চার কম ওজনের হওয়া, গর্ভপাত, মৃতপ্রসব, বিকাশজনিত সমস্যা এবং জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। কেবলমাত্র ধূমপান ত্যাগ করার মাধ্যমেই এই স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলিকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা এবং সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়।
কিভাবে ধূমপান বন্ধ করা যায়:
ধূমপান ত্যাগ করা একটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অর্জনযোগ্য লক্ষ্য। নিচের কৌশলগুলি ধূমপান বন্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।
১. শুরুতে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধূমপান ছাড়া যতো কঠিন, পুনরায় তা চালু করা ততো সহজ। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যদের সমর্থন এক্ষেত্রে মূল্যবান।
২. নিকোটিন প্রতিস্থাপন থেরাপি ব্যবহার।
৩. ধূমপানের তাড়না থেকে মুক্ত থাকতে বিকল্প যেমন রঙ চা, দারুচিনি, শুকনো আদা কুচি ব্যবহার করা।
৪. ধূমপানের সাথে যুক্ত ট্রিগার এবং পরিস্থিতি সনাক্ত করে তা এড়িয়ে চলা।
৫. ব্যায়াম, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, ধ্যান বা মেডিটেশনের মতো স্ট্রেস-কমানোর কৌশলগুলি অনুশীলন করা।
৬. ধূমপান ত্যাগ করার স্বাস্থ্য সুবিধা এবং কারণগুলি বারবার মনে করা।
বাংলাদেশ সরকার ধূমপান প্রতিরোধে বেশ কিছু নীতি বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর বর্ধিত কর, সিগারেট প্যাকেটের গায়ে গ্রাফিক স্বাস্থ্য সতর্কতা, পাবলিক প্লেসে ধূমপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ধূমপানের স্বাস্থ্যঝুঁকি তুলে ধরে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং জাতিসংঘ (ইউএন) বিশ্বব্যাপী ধূমপানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে। হু-এর ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এই শিল্পের উপর ট্যাক্স বৃদ্ধি করা, তামাকের বিজ্ঞাপন ও প্রচার নিষিদ্ধ করা আর ধূমপান-মুক্ত নীতি বাস্তবায়ন করা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) তামাকের ব্যবহার এবং তামাকজনিত মৃত্যু হ্রাস করার লক্ষ্যগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই বৈশ্বিক প্রচেষ্টার লক্ষ্যগুলি অর্জিত হলে বিশ্বের দেশগুলি রাষ্ট্রীয়ভাবে তামাকের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে আর এভাবেই একটি তামাকমুক্ত বিশ্ব তৈরি হবে, যেখানে আর শিশু কিশোর ও বয়ষ্ক মানুষেরা বিষাক্ত ধোঁয়ায় নি:শ্বাস নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর মিছিলে যোগ দিবে না।
ডা: এস এম ইয়ার ই মাহাবুব
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক
কার্ডিওলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ
এমএইচ