.
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক জিল্লুর রহমানের জন্মভূমি কিশোরগঞ্জ-৬ আসন। এই আসন থেকে তিনি ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি ছাড়াও একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলার ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ১৬৭ নম্বর আসন হচ্ছে এই কিশোরগঞ্জ-৬। পূর্বে এটি কিশোরগঞ্জ-৭ আসন ছিল। বরাবরই আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত।
এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের ছেলে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এ আসনটিতে জাতীয় পার্টি একবার এবং বিএনপি থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। বাকি সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, এই আসনে নির্বাচনী উত্তাপ ততই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন নাজমুল হাসান পাপন। আর বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে আছেন মো. শরীফুল আলম। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি।
ভৈরব উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এবং কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের সব ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৬ নির্বাচনী এলাকা। জেলা নির্বাচন অফিসের সর্বশেষ তথ্যমতে, এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৬ জন। এর মধ্যে ভৈরব উপজেলায় পুরুষ এক লাখ ১২ হাজার ২২০ জন ও মহিলা এক লাখ সাত হাজার ৩৫ জন। অন্যদিকে কুলিয়ারচর উপজেলায় পুরুষ ৭৫ হাজার ২৪১ জন ও মহিলা ভোটার সংখ্যা ৭৩ হাজার ৪৯০ জন।
এ আসনে অধিক ভোটার নিয়ে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের হেভিওয়েট দুইজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এর বাইরে আরও রাজনৈতিক দলের প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। অপরদিকে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি মো. শরীফুল আলম। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট দলের ভৈরব উপজেলার সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ রুবেল হোসেনসহ জাতীয় পার্টির দুইজনের নাম শোনা যাচ্ছে। এরা হলেনÑ অ্যাডভোকেট আইয়ুব হোসেন ও নূরুল কাদের সোহেল। তবে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের রুবেল হোসেন গেল নির্বাচনেও সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এবার তিনি ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনে সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন।
কিশোরগঞ্জ-৬ সংসদীয় আসনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিলুর রহমান ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাকে দেশের উনিশতম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ফলে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তার আসনটি সাংবিধানিকভাবে শূন্য ঘোষণা করে। এরপর জিল্লুর রহমানের শূন্য এ আসনে তারই ছেলে নাজমুল হাসান পাপন উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী ধারাবাহিকতায় তিনি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চাচ্ছে আসনটিতে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে। এ জন্য দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এ সময় তারা সংসদীয় আসনে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা- জনগণের সামনে তুলে ধরছেন। পাশাপাশি তারা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করে প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে তাদের হারানো আসনটি উদ্ধার করতে। এ জন্য তারা নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
ভৈরব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ সায়দুলাহ মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, কিশোরগঞ্জ-৬ নির্বাচনী এলাকা আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে ভালোবাসেন বলেই তিনি ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তিতে তার ছেলে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এই এলাকার এমপি নির্বাচিত হন। তিনি বিজয়ী হয়ে ভৈরব-কুলিয়ারচর এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নসাধন করেছেন। ১০০ শয্যা হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার, বিসিক শিল্পনগরী, আইভি রহমান স্টেডিয়াাম, পৌর শিশুপার্ক, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তা ছাড়া ভৈরব-কুলিয়ারচরে গৃহহীনদের জমি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন। আর তাই দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ আবারও নাজমুল হাসান পাপনকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে বলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সেন্টু বলেন, ভৈরব-কুলিয়ারচর এলাকায় আওয়ামী লীগের নাজমুল হাসান পাপন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। দলমত নির্বিশেষে আপামর জনতা নাজমুল হাসান পাপনকে আবারও আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করবেন। তিনি আরও বলেন, দলের ভেতর কোনো কোন্দল নেই। দলের নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনে নাজমুল হাসান পাপনকে নির্বাচিত করার জন্য এরই মধ্যে মাঠে রয়েছে। ইনশাআল্লাহ্ আসছে নির্বাচনে বিপুল ভোটে নাজমুল হাসান পাপন বিজয়ী হবেন।
অতীতের নির্বাচনগুলোর ভোটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, আসনটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট সব সময় কাছাকাছি ছিল। জয়-পরাজয়ে ভোটের ব্যবধানও ছিল কম। তাই এলাকার সাধারণ মানুষ মনে করে আগামী নির্বাচনেও ভোটের ফল কাছাকাছি থাকবে। এ জন্য বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সঙ্গে আসছে নির্বাচনে দুই দলের প্রার্থীর লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।
সরেজমিনে ভৈরব-কুলিয়ারচর এলাকা ঘুরে জানা যায়, এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নসাধন করলেও তার দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। তারা বলেন, নির্বাচন এলে নেতাকর্মীদের কদর বাড়ে। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে গেলে পরে আর কেউ খোঁজ রাখেন না।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবহেলিত ও উন্নয়নবঞ্চিত এ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের প্রধান রূপকারই হচ্ছেন প্রয়াত জিল্লুর রহমান ও তার ছেলে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এলাকার স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ আধুনিক চিকিৎসা সেবার ব্যাপক মান ও প্রসার ঘটেছে। এক সময়ের উন্নয়নবঞ্চিত ভৈরব ও কুলিয়ারচর আধুনিক শহরে রূপান্তর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন টানা তিনবারের সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন।
অপরদিকে বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম এখানে দলটির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, বিএনপির জন্য দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি। এলাকার মানুষ সব সময় আমাকে পাশে পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নেই।
ভৈরব উপজেলা বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জ-৬ ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনটিতে ইতোমধ্যে বিএনপি থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। আর তাই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি।
ভৈরব পৌর বিএনপির সভাপতি হাজি শাহীন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাজমুল হাসান পাপন বিপুল ভোটে পরাজিত হবেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে ভৈরব পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে বিপুল ভোটে বিএনপির প্রার্থী শরীফুল আলম নির্বাচিত হবেন।
জাতীয় পার্টির নূরুল কাদের সোহেল বলেন, দল তাকে মনোনয়ন দেবে, তাই তিনি ভৈরব ও কুলিয়ারচরের মানুষের পাশে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। অত্র এলাকার মানুষ জাতীয় পার্টিকে ভালোবাসে।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট কিশোরগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রুবেল হোসেন বলেন, আসন্ন ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে তিনি মনোনয়ন পাবেন। সে মোতাবেক তিনি ভৈরব-কুলিয়ারচরে জনসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জোর দাবি জানিয়েছেন।
এ ছাড়া এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে দলটির ভৈরব উপজেলা কমিটির সভাপতি আলহাজ মো. মুসা খান মনোনয়ন পাবেন। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হাতপাখা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।