ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৮ মার্চ ২০২৩

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

আজ পবিত্র মাহে রমজানের ষষ্ঠ দিবস

আজ পবিত্র মাহে রমজানের ষষ্ঠ দিবস। রমজান মাস হলো কুরআন নাযিলের মাস। বস্তুত মাহে রমজানের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হলো এ মাসে আল কুরআন নাযিল হয়েছে। কুরআন নাযিলের কারণে মাসটি যেমন চির সম্মানিত, তেমনি কুরআন তিলাওয়াত করার কারণে জীবনে কুরআন শরীফের মর্মার্থ অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদাবান হয়। এজন্য এ মাসের অন্যতম প্রধান ইবাদত এ পবিত্র গ্রন্থের তিলাওয়াত ও মর্ম অনুধাবন।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম মানব জাতির জন্য মহান ¯্রষ্টা আল্লাহপাকের পক্ষ হতে সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ হিদায়াত বা দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ। এটি গোটা মানব জাতির জন্য পথপ্রদর্শক। এখানে শিক্ষা ও সভ্যতা অর্জনের সব উপাদান ও সূত্র নিহিত রয়েছে। এককালে এটিকে মর্যাদা দান, তিলাওয়াত ও অধ্যয়নের মাধ্যমে মুসলিম জাতির সমৃদ্ধময় গৌরবদীপ্ত উত্থান ঘটেছে। এর আগে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির জন্য যেসব আসমানি গ্রন্থ প্রেরণ করেছিলেন, তা কেবল সমসাময়িক ও স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য।
সূরা আলে ইমরানের ২৩নং আয়াতে বলা হয়েছে- ওহে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনি কি তাদের দেখেননি? যারা কিতাবের কিছু অংশ পেয়েছে-আল্লাহর কিতাবের প্রতি তাদের আহ্বান করা হয়েছিল, যাতে তাদের মধ্যে নানা বিষয়াবলী নিয়ে মীমাংসা করা যায়। অতপর তাদের মধ্যে একদল তা অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।‘ অর্থাৎ পূর্ববর্তী জাতিগুলোর জন্য ছিল কিতাবের অংশ বিশেষ;  যা দিয়ে তারা বিচার-আচার সম্পন্ন করত।
পক্ষান্তরে কুরআনুল কারীমের ভূমিকা ও প্রভাব সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে বলা হয়েছে: এ সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই। (এটি) পথ প্রদর্শনকারী পরহেজগারদের জন্য...।’ উদ্ধৃত অংশে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কুরআন শরীফ তাদেরই সঠিক পথ দেখাবে, যারা সঠিক পথ  পাওয়ার জন্য আগ্রহী ও উদগ্রীব থাকে, হিদায়াতের মন-মানসিকতা নিয়ে এ পবিত্র গ্রন্থ তিলাওয়াত করে। যারা পুতপবিত্র মনপ্রাণ নিয়ে এটি অধ্যয়ন ও তিলাওয়াত করবে, দুনিয়া ও আখিরাতে তারা অবশ্য সৌভাগ্যময় জীবনের অধিকারী হবে। এ কুরআনকে বলা হয়েছে শিফাউন লিন-নাস- মানব জাতির জন্য নিরাময় বস্তু। আল্লাহতায়ালা বলেন, এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা ধারা, আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশাবলী।’-(৩:১৩৮)।
কুরআনুল কারীম মানুষকে ন্যায়বিচারে উৎসাহিত করে, হালাল-হারাম চেনার পথ দেখায়, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি দূূরীভূত করে সুন্দর, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ উপহার দেয়। সূরা আল ইমরানে আল্লাহপাক এক দীর্ঘ আয়াতে মুসলমানদের তার করুণার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আর তোমরা সকলে আল্লাহর রুজ্জুুকে সুদৃঢ় হাতে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন।

তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অত:পর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে এখন তোমরা তার অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা অবস্থান করেছিলে এক অগ্নিকু-ের পাড়ে। অতপর তা থেকে তিনি তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হতে পার।’-(আয়াত নং-১০৩)।

পবিত্র কুরআন সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাচীনতম উৎস-সূত্র। এখানে শুধু নামাজ কালামের কথা বলা হয়নি, সৃষ্টি রহস্য ও বিশ্ব ইতিহাসের বহু তত্ত্ব ও তথ্যে সমৃদ্ধ এ মহাগ্রন্থ। এই তো মাত্র সাড়ে চার দশক আগে (১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই) মানুষ প্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে। এ ঐতিহাসিক দিনে নিল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স, এডুইন অলড্্িরন প্রমুখ সৌভাগ্যবান মানব সন্তানগণ চাঁদের দেশে মানব জাতির পদচিহ্ন আঁকেন।

যে সময়, যে যুগে তারা এ মহাবিজয়ের সুসংবাদ বয়ে এনেছেন তখনো মানুষের এক বিরাট অংশ তা সহজে মেনে নিতে পারেনি। বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি। তাদের বিশ্বাস হলো, মানুষের পক্ষে আকাশ জয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু আজ ধীরে ধীরে তাদের সে বিশ্বাস ভাঙছে, তারা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর কারিশমা বলে ক্রমেই অনুধাবন করতে ও প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হচ্ছে।

অথচ এর দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম ও তার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ঘোষণা করেছে। বিজ্ঞানময় পবিত্র কুরআনুল হাকিম বিজ্ঞানপূর্ণ ও বিজ্ঞাননির্ভর বহু আয়াত বর্ণনা করেছে। আকাশপথে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ ও চন্দ্রপৃষ্টের অবস্থা ও অবস্থান নির্দেশ করেছে প্রাজ্ঞ ভাষায়। এর জন্য বিস্তারিত দেখুন, সুরা ইয়াসিন ও সুরা নাযমের তাফসির। আমাদের প্রিয় নবী হযরত রাসূলে মাকবুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং পবিত্র মি’রাজ গমন করে মানব জাতির আকাশ জয়ের বিস্ময়কর অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেন।
কুরআনে কারীম আমাদের জন্য নিয়ে আসে আর্থ-সামাজিক উন্নতি, সৌভাগ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। এটি ভক্তিসহকারে বরকত লাভের আশায় তিলাওয়াত করলে আল্লাহ অভাবীর অভাব মোচন করেন, দুঃখী মানুষের দুঃখ দূর করেন। অন্তর ভরে দেন প্রশস্ততা ও প্রশান্তিতে। এ বিষয়ে আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) ঐতিহাসিক ইবনুল আসাকীরের বরাত দিয়ে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন।
ঘটনাটি হলো এই, বিখ্যাত সাহাবী ও কুরআন বিশেষজ্ঞ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যখন অন্তিম রোগ শয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন মুসলিম জাহানের তৎকালীন খলিফা আমীরুল মো’মেনীন হযরত উসমান (রা) তাকে দেখতে যান। এ সময় তাদের মধ্যে শিক্ষাপ্রদ কথোপকথন হয়। তা নিম্নরূপ :
হযরত উসমান : মা তাশতাকী- আপনার অসুখটা কি?
হযরত ইবনে মাসউদ : আমার পাপসমূহই আমার অসুখ।
ওসমান গণি : আপনার চাহিদা বা বাসনা কি?
ইবনে মাসউদ : রাহমাতু রাব্বী অর্থাৎ আমার মহান প্রভু আল্লাহপাকের দয়া ও রহমতের ভিখারি।
ওসমান গণি : আমি আপনার জন্য কোনো চিকিৎসক ডাকব কি?
ইবনে মাসউদ : চিকিৎসকই আমাকে রোগাক্রান্ত করেছে।
উসমান গণি : আমি আপনার জন্য সরকারি বায়তুল মাল থেকে কোনো উপঢৌকন পাঠিয়ে দেব কি?
ইবনে মাসউদ : আপনি চিন্তা করেছেন যে, আমার কন্যারা দারিদ্র্য ও উপবাসে পতিত হবে। কিন্তু আমি এরূপ চিন্তা করি না, কারণ আমি কন্যাদের জোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছি যে, তারা যেন প্রতি রাতে (কুরআন শরীফের) সূরা ওয়াকিয়া পাঠ করে। কেননা মহানবী (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এশার নামাজের পর সূরা ওয়াকিয়া তিলাওয়াত করে, সে কখনো উপবাসে আক্রান্ত হবে না।’-(ইবনে কাসীর)।
এভাবে কুরআন শরীফ ও হাদিস শরীফে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়নের বহুবিধ বরকত ও উপকারিতার কথা বর্ণিত হয়েছে। আমরা আমাদের জীবনের স্বার্থে কুরআনমুখী অভ্যাস গড়ে তুলব।

×