ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় মাসে আটক ২৪, জব্দ ২৩ কেজি ॥ ব্রিফিংয়ে র‌্যাব

দেদার আসছে হেরোইন রাজধানীর ৩২ স্পটে চলে বেচাকেনা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেদার আসছে হেরোইন রাজধানীর ৩২ স্পটে চলে বেচাকেনা

হেরোইনসহ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব

দেদার দেশে আসছে হেরোইন। হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে মূল্যবান এই মাদকের কারবার। আকাশ, নদী ও সড়কপথে আনা চালান ধরাও পড়ছে। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকায় ধরাও পড়েছে দুটি চালান। বিভিন্ন কৌশলে বিদেশ আনা হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করার নিরাপদ উপায়ও বের করেছে মাদক কারবারিরা। এ জঘন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে গরিব দুঃখী নারী সদস্যদেরকেও। আবার বাংলাদেশ হয়ে কয়েকটি দেশেও কাউন্টার পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে বেশ ক’জন। র‌্যাব ও মাদক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের  পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, বেশ ক’টি চক্র এ কাজে সক্রিয়। তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে নদীপথে প্রতি মাসে ৪-৫ কেজি হেরোইন নিয়ে আসছে। শুধু একটি চক্রেই অন্তত এক ডজন নারী সদস্য জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যাদেরকে ধরাও হয়েছে। এমন আরও বেশ ক’টি চক্র সক্রিয়।  
র‌্যাব জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার একটি শক্তিশালী চক্রকে ধরা হয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। শাকিব নামের একজন মূল হোতাও ধরা পড়েছে। শুধু তার কাছ থেকেই সাড়ে ৫ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে। অপর সহযোগীরা হচ্ছে তার স্ত্রী মোছা. রাজিয়া খাতুন (৩৩) ও মোছা. সেলিনা খাতুন ওরফে শিরিনা (৩৮)। বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১২ যৌথ অভিযানে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। দেশে
বর্তমানে যে কোনো মাদকের চেয়ে হেরোইনের চাহিদা বেড়েছে বেশি। এক সময় ফেন্সিডিল ও ইয়াবার দাপট থাকলেও এখন দেখা যাচ্ছে হেরোইনের মতো মূল্যবান ও ক্ষতিকর মাদকের চোরাচালানি বাড়ছে। রাজধানীতে অন্তত ৩২ স্পটে হেরোইন বেচাকেনা হয়। এতে কমবেশি দেড় শতাধিক মাদক কারবারি সক্রিয়। গত ছয়মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানেই ধরা পড়েছে অন্তত ২৪ জন। জব্দ করা হয়েছে ২৩ কেজি হেরোইন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়ে বৃহস্পতিবার।
এ বিষয়ে র‌্যাব জানিয়েছে, ভারত থেকে নিয়মিতই দেশে আনা হচ্ছে হেরোইনের চালান। সেটা আবার দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আকাশপথে পাচার করা হচ্ছে বিদেশে। এমনই তথ্য মিলেছে ধৃত শাকিব খানের কাছ থেকে। সে জানিয়েছে, সীমান্তবর্তী এলাকা হয়ে নদীপথে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ কেজি হেরোইন আনা হতো। এ চক্রের নারী সদস্যদের মাধ্যমে সেসব হেরোইন পৌঁছে দেওয়া হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খদ্দেরদের হাতে। চাহিদা অনুযায়ী বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিয়ত ৫০০/৬০০ গ্রাম করে হেরোইন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিত।
প্রতিটি চালান পরিবহনের জন্য বহনকারীকে ১৫-২০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। চালানের পরিমাণ বেশি হলে শাকিব বিভিন্ন সময় তার নিজের মোটরসাইকেলযোগে পরিবহন করত। এই চালানে তিন কেজির বেশি হেরোইন থাকায় শাকিব নিজেই তা বহন করছিলেন। শাকিব তার নওগাঁর বাসায় আরও দুই কেজি হেরোইন থাকার ব্যাপারে তথ্য দেয়। পরে তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে তার স্ত্রী গ্রেপ্তার সেলিনা খাতুনের কাছ থেকে দুই কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়।
শাকিব আগে চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল। এলাকায় তার বিরুদ্ধে একাধিক চুরির অভিযোগ রয়েছে। গত প্রায় দুই বছর ধরে সে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। সে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তার ব্যবসায়িক সহযোগীর মাধ্যমে হেরোইন সংগ্রহ করে প্রথমে নিজের বাড়িতে সংরক্ষণ করত। চাহিদা অনুযায়ী বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করত। বিভিন্ন সময় সে নিজের মোটরসাইকেলে করে বিভিন্ন স্থানেও এসব মাদকের চালান পরিবহন করত।
এ ছাড়াও চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সময় যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক কারবারিদের কাছে হেরোইন সরবরাহ করত শাকিব। হেরোইন বিক্রির টাকা সংগ্রহ করা হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
হেরোইন পাচারের বিষয়ে শুক্রবার এক বিফ্রিংয়ে র‌্যাব মিডিয়া পরিচালক উইং কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন- শাকিবের স্ত্রী রাজিয়া খাতুনও স্বামীর হেরোইন ব্যবসার সহযোগী। প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে আনা হেরোইনের একটি অংশ শাকিব নিজ বাড়িতে তার স্ত্রীর হেফাজতে রাখত। বিভিন্ন সময় আস্থাভাজন মাদক কারবারিরা হেরোইন সংগ্রহ করতে এলে সেলিনা তাদের হেরোইন সরবরাহ করত।
এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত সেলিনা খাতুন ওরফে শিরিনা শাকিবের হেরোইন চক্রের অন্যতম নারী সহযোগী। সে প্রায় এক বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার শাকিবের সঙ্গে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন স্থানে হেরোইন সরবরাহ করেছে সেলিনা। বৃহস্পতিবার রাতেও গাজীপুর ও সাভারের বিভিন্ন স্থানে হেরোইন সরবরাহ করার জন্য নওগাঁ থেকে শাকিবের সঙ্গে রওনা হয় সে। পথে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে র‌্যাবের হাতে দুজনই গ্রেপ্তার হয়।
এদিকে একই রাতে কেরানীগঞ্জে ৭৫ গ্রাম হেরোইনসহ তিন মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তারা হলেন মো. তারিকুল ইসলাম (৪০), মো. গোলজার হোসেন ও মো. সোহাগ (২৯)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা পেশাদার মাদক কারবারি। তারা বেশ কিছুদিন ধরে সীমান্তবর্তী এলাকা হতে হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে আসছিলেন। ধৃত এ দুজনও শাকিবের নেটওয়ার্কে কাজ করত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হঠাৎ কেন হেরোইনের চোরাচালান বেড়েছে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এখন নানা পদক্ষেপের দরুন ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের আমদানি কমছে। তা ছাড়া মাদকসেবীরা নিজেদের রুচিতেও পরিবর্তনের একটা ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বেশ ক’জন মাদকসেবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, তারা এই ছয়মাস আগেও ইয়াবাতে আসক্ত ছিল। কিন্তু এখন আর ইয়াবাতে তাদের নেশার পূর্ণতা আসে না। সেজন্য তারা কিছু দাম দিয়ে হলেও ইয়াবার পরিবর্তে হেরোইনের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। ইয়াবার চেয়ে হেরোইন ব্যয়বহুল হলেও নেশার তাদের কাছে অন্য হিসাব রয়েছে। যেমন একটা ইয়াবার দাম তিন থেকে চারশ টাকা। দিনে যদি দুটি লাগে তাহলে যে খরচ হয়, সে টাকায় হেরোইন খেলে আরও বেশি কার্যকর নেশা হয়। এজন্যই ইয়াবার চেয়ে হেরোইনের চাহিদা ও মাদকপ্রিয়তা বাড়ছে।  

 

×