ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনিশ্চয়তা ॥ প্রাথমিকের বই নিয়ে বাড়ছে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:৩৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

অনিশ্চয়তা ॥ প্রাথমিকের বই নিয়ে বাড়ছে

রাজধানীর মাতুয়াইলে ছাপাখানায় ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা

আগামী বছর জানুয়ারির এক তারিখে হবে বই উৎসব। ইতোমধ্যে বই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ফলে বই ছাপাতে প্রেস মালিকদের হাতে সময় নেই এক মাসও। কাগজের মূল্য বৃদ্ধি ও পাল্প সংকটের মধ্যেও মাধ্যমিক স্তরে বই ছাপার অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে মাধ্যমিক স্তরের ১২ কোটি বই ছাপা হয়েছে। কিন্তু মানের প্রশ্নে মুদ্রণকারী ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মধ্যে আস্থার সংকটে শুরু হচ্ছে না প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ। ফলে নতুন বছরে কোমলমতি বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়া নিয়ে বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
নতুন বই মানেই ঝা চকচকে কাগজে লেখনীর সুঘ্রাণ। বইয়ের এই উজ্জ্বলতার প্রধান উপকরণ ভার্জিন পাল্প। যা বেলজিয়াম বা জাপান থেকে আমদানি করা হয় দেশে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে  দেশে পাল্পের আমদানি কমেছে। কিন্তু দেশে এটি একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না তা মানতে নারাজ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। জনকণ্ঠকে তারা জানান, পাল্প পাওয়া যাচ্ছে না এটাকে পুঁজি করে বই প্রস্তুতকারীরা আমাদের নিম্নমানের বই নিতে বাধ্য করছে।

আমাদের কাজ হলো জানুয়ারির এক তারিখে বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে পুঁজি করে তারা আমাদের জিম্মি করেছে। কাগজ সংকট ও মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নিতে চাইছে ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আমাদের কাছে বইয়ের যে নমুনা দেওয়া হয়। সেটা ভাল থাকে।  আর শিক্ষার্থীদের হাতে যে বই তুলে দেওয়া হয়, তা একেবারেই খারাপ। সেই বইয়ের কোন  মান নেই। আপনি (বই ব্যবসায়ীরা) টাকা নিবেন ভাল বই দেওয়ার কথা বলে অন্যদিকে জঘন্য বই দিবেন তা তো হতে পারে না। আর মান যাচাই করা অধিদপ্তরেরও দায়িত্ব। কিন্তু বইয়ের মান নিয়ে যা করা হচ্ছে তাতে বাচ্চাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।
বই মুদ্রণকারীরা জানান, মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় গত মঙ্গলবার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের ছাপানোর চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। প্রাথমিকের এই দুই শ্রেণির একটি বইও ছাপা হয়নি এখনো অধিদপ্তর যে ধরনের কাগজ চেয়েছে বাজারে মাত্র একটি কাগজ কল সেই কাগজ বিক্রি করছে। কাগজ কলটির নাম আম্বার পেপার মিল। কিন্তু এত ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছে যে এখন রেশনিং করে কাগজ দিচ্ছে। বসুন্ধরা, মেঘনা, সোনালী এই সব কাগজ কল উৎপাদন করছে না। ফলে মানসম্মত কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না।

আবার সংকটে নিম্নমানের কাগজের মূল্যও চড়া। যখন টেন্ডার দেওয়া হয়েছে তখন কাগজের টন ছিল ৯০ হাজার। এখন এই দাম দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫-২০ হাজার টাকা। এরপরও কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরফলে প্রেসগুলো একটি বইয়ের ৫ ফর্মা ছেপে বসে আছে। ১০ ফর্মা না ছাপলে ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়াও গত বছর প্রাথমিকের বই ছাপানোর প্রায় ২০ কোটি টাকা এখনো বকেয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই দেওয়ার ৬ মাস পর্যন্ত জরিমানা বা বই বদলে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু গত বছর ৬ মাস পরও পুস্তক ব্যাবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিবার বিল নিয়েও ঝামেলা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কাজ শুরু করা হলো, বই ছাপানোর পরে অধিদপ্তরের পছন্দ হয় না। ফলে কাগজ-কালি-শ্রম পুরোটাই বৃথা যায়। এসব কাজের টাকাও পাওয়া যায় না। যে কারণে এবছর এখনো প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে সমঝোতার একটি চেষ্টা চলছে।
প্রাথমিকে এখনো অচলাবস্থা আছে জানিয়ে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা বলেন, মাধ্যমিকে এখন পর্যন্ত ১২ কোটি বই ছাপা হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় তা ৫৫ ভাগের বেশি। প্রাথমিকের বই কত ভাগ ছাপানো হয়েছে এ বিষয়ে কোন কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এটা নিশ্চিত বই উৎসব হবে এবং শিক্ষার্থীদের হাতেও নতুন বই উঠবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত জানুয়ারির এক তারিখে শিক্ষার্থীদের হাতে অন্তত তিনটি বই দেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রেস মালিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মধ্যকার চলমান সংকট রয়েছে বলেও স্বীকার করেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সংকটের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও জানানো হয়েছে। কিন্তু এই দুই শ্রেণির বই খুব ছোট আকারের। পুরোদমে কাজ শুরু হলে সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। নির্ধারিত দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে নতুন বই।
বিভিন্ন কাগজকল কাগজ উৎপাদন করছে না এ বিষয়ে এনসিটিবির ভূমিকার বিষয়ে তিনি বলেন, এনসিটিবি ক্রেতা। কিন্তু আমরা এমন একজন ক্রেতা যারা কেনার বাইরেও অনেক কাজ করে থাকে। এখন শীতের মৌসুম হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট নেই। কিন্তু যখন ছিল তখনো আমরা বিদ্যুৎ সচিবকে এ বিষয়ে অনুরোধ করেছি। আমরা কাগজের কল মালিকদের সঙ্গে বসেছি। বিভিন্ন গোডাউনে যেসব পুরোনো কাগজ ছিল কাঁচামাল হিসেবে সেটিরও ব্যবস্থা করেছি।
প্রাথমিকের চারটি টেন্ডার। এরমধ্যে একটি প্রি-প্রাইমারি। যা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। অন্যটা হলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সেটিও শেষ। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বইয়ের কাজ আংশিক হয়েছে। কিন্তু এখনো প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের কাজ শুরু হয়নি। এ বিষয়ে চুক্তিও সম্পাদন হয়েছে গত মঙ্গলবার কিন্তু কাগজ নিয়ে কিছু সংকটের কারণে এই কাজ এখনো শুরু হয়নি।
সূত্র জানায়, বইয়ের টেন্ডার, মান যাচাই, টাকা পয়সা, বিল-ভাউচার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বইয়ের ক্রেতা হলো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এনসিটিবির মাধ্যমে বই তারা শিক্ষার্থীদের দেয়। এখানে একটি ¯œায়ু যুদ্ধ চলে আসছে দীর্ঘদিন। এনসিটিবির দাবি তারা বইয়ের মালিক।

অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলে আসছে, আমরা বই কিনি, টাকা না দিলে বই ছাপা হবে না। এর সঙ্গে আরও রয়েছে পুস্তক প্রকাশক ও মুদ্রণকারীরা। এর ফলে প্রতিবছর ত্রিমুখী একটি সমস্যা   তৈরি হয়। যা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এর সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে সরকারের বিনামূল্যের বইয়ের দাম ও মান নিয়ে।
আগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির কোমলমতি শিশুরা চাররঙা ঝকঝকে বই হাতে পেত। এখন নতুন করে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও পাবে রঙিন বই। এ কারণে এ দুই শ্রেণির পাঠ্যবই এবার কিছুটা মোটা হবে। তবে আগামী বছরের শুরু থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কারণে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বই বদলে যাচ্ছে। নতুন করে লেখা হয়েছে পাঠ্যবই। এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩৪ কোটি ৮৫ লাখ কপি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে।

তার মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সাড়ে ৯ কোটি বই আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের বই ছাপাতে এবার ব্যবহৃত হচ্ছে ১ লাখ ১৯ হাজার টন কাগজ। এর মধ্যে ১৪ হাজার টন এনসিটিবি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে দিয়েছে। বাকি ৮৫ হাজার টন নিজেরাই কিনছে মুদ্রণকারীরা। পাশাপাশি প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপতে এ বছর সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের জন্য ৩০০ কোটি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ব্যয় হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, শিক্ষামন্ত্রী ও সচিব মহোদয়ের ভাষ্য অনুযায়ী বই পাবে শিক্ষার্থীরা। অর্থনৈতিক কারণেই হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় কারণে, আমাদের বই দেওয়াটাও দায়িত্ব ও কর্তব্য। সব ব্যবসায়ীই ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে বই ছাপায়। ফলে বই যত দ্রুত ছাপানো যাবে, বিল তত দ্রুত পাওয়া যাবে।

কিন্তু কাগজ ও পাল্প সংকটের কারণে আমরা আশাবাদী হতে পারছি না। তিনি বলেন, মাধ্যমিকে বইয়ের মান বা কাগজের উজ্জ্বলতা নিয়ে এনসিটিবি কিছুটা ছাড় দিলেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর অনড় অবস্থানে। যার কারণে মাধ্যমিকের বই ৫৫ ভাগ ছাপা হলেও প্রাথমিকের কাজ পিছিয়ে আছে। এনসিটিবির নির্দেশনা অনুযায়ী কাগজের উজ্জ্বলতা থাকতে হবে ৮৫ ভাগ। যা ভার্জিন পাল্প ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু বিদেশ থেকে পাল্প আমদানি না হওয়ায় এবার কাগজের উজ্জ্বলতা কম থাকবে।

×