
সিরাজগঞ্জে চলনবিলের মিঠা পানির মাছ চাতালে শুকানো হচ্ছে
মিঠা পানির শুঁটকি, স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। লোনা পানির শুঁটকির চেয়ে মিঠা পানির শুঁটকির কদরই বেশি। দেশের উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ-পাবনা ও নাটোর জেলা সীমানার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা বৃহত্তর চলনবিলের মিঠা পানির উৎপাদিত মাছ এখন চাতালে শুকানো হচ্ছে। চলনবিলকে ঘিরে গড়ে উঠা শুঁটকির এই চাতালের সংখ্যা শতাধিক। বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। যাচ্ছে পাশর্^বর্তী ভারত, দুবাই, কাতারসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
এ সব চাতাল অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়। বাংলা সনের কার্তিক- অগ্রহায়ণ মাসে চলনবিলের পানি কমে গেলে বিস্তীর্ণ এই জলাভূমির শুকনো মাটিতে নানা জাতের শস্য আবাদের পাশাপাশি শুঁটকির চাতালও গড়ে তোলা হয়। এ মৌসুমে চলনবিলের মাঠে মাঠে শুঁটকির গন্ধ পাওয়া যায়। চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকিকে বলা হয় ইয়োলো গোল্ড। রপ্তানি করা হয় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। শুঁটকি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশের মহিষলুটি এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী নান্নু হোসাইন জানান, মহিষলুটিতে ১৩/১৪টি শুঁটকির চাতাল রয়েছে। এছাড়াও চলনবিল ঘিরে চাতালের সংখ্যা শতাধিক।
এ অঞ্চলের শুঁটকির কদর কেন বেশি প্রশ্নে তিনি জানান, লোনা পানির মাছের শুঁটকির চেয়ে মিঠা পানির শুঁটকির স্বাদ ভিন্ন রকম। দেশের উত্তরাঞ্চলে জেলায় জেলায় মিঠা পানির শুঁটকির কদর বেশি। বিদেশীদের কাছে মিঠাপানির মাছের শুঁটকির চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চলনবিলের শুঁটকি ব্যবসায়ীরা শুঁটকি প্যাকেট করে উত্তরের জেলা নীলফামারীর সৈয়দপুরে মহাজনের কাছে পাঠায়। সেখান থেকে রপ্তানি করা হয় পার্শ^বর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। দেশের মানুষের কাছেও মিঠাপানির মাছের শুঁটকির চাহিদা লোনা পানির মাছের শুঁটকির চেয়ে বেশি। চলনবিল দিনে দিনে শুকনো ভূমিতে পরিণত হয়ে মাছের প্রজনন কমেছে, তবে শুঁটকি মাছ চলনবিলের নতুন সংযোজন।
সিরাজগঞ্জ-পাবনা ও নাটোর জেলার কোল ঘেঁষে প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। বৃহৎ এই জলাভূমিতে বর্তমান সময়ে আর থৈ থৈ পানি নেই। বিলের অনেকটা ভূমিজুড়ে ধান-পাট, সবজিসহ নানান ফসলের আবাদ হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিলের নিচু ভূমির খালগুলোতে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। এই মাছের সামান্য অংশ স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি হয়। আহরিত মাছের চারভাগের তিনভাগই যায় শুঁটকি বানানোর চাতালে। বিভিন্ন পয়েন্টে শুঁটকির চাতাল ও মাছ শুকানোর আলাদা স্থান তৈরি করা হয়েছে। বিলপাড়ের এলাকায় প্রবেশের পর শুঁটকির গন্ধ টেনে নিয়ে যায় চাতালের দিকে।
এ ছাড়াও বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে ছোট ছোট অস্থায়ী চাতাল। বিলের মধ্যেই এ ধরনের শতাধিক অস্থায়ী চাতাল রয়েছে। এসব চাতালে মিঠাপানির নানা জাতের মাছের শুঁটকি বানানো হচ্ছে। চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, সরপুঁটি, খলসে, চেলা, ট্যাংরা, বাতাসি, মলা, ঢেলা, টাকি, বাইমসহ মিঠাপানির সব ধরনের মাছের শুঁটকি বানানো হচ্ছে। কার্তিক মাস থেকে পৌষ-মাঘ মাস পর্যন্ত শুঁটকি তৈরি হয় বলে জানান, চাতাল শ্রমিক আমিরুল ইসলাম। এসব চাতালে এই মৌসুমে কমবেশি প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করে। চাতাল শ্রমিকদের কাছে কড়া রোদই মহৌষুধ বলে জানান ওই শ্রমিক। প্রতিমণ তাজা মাছ শুকালে ২০ কেজি শুঁটকি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি শুঁটকি প্রকার ভেদে ৫০ টাকা থেকে ৫শ’ টাকায় বিক্রি হয়। প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এ বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে।
একজন রপ্তানিকারক জানালেন, বর্তমানে ভারত, মালয়েশিয়া সৌদি আরব কাতার বাহরাইন দুবাই ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে এই শুঁটকি যাচ্ছে। মহিষলুটির একজন ব্যবসায়ী জানালেন, তার চাতালে গড়ে ৭০ মেট্রিক টন শুঁটকি তৈরি হয়েছে। তবে সব চাতালের হিসেব এক নয়। তার হিসেব মতে গড়ে ৪০ টন প্রতি চাতালে শুঁটকি তৈরি হলে চলনবিল থেকে গত বছরে চার হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি শুঁটকি তৈরি হয়ে রপ্তানির তালিকায় যোগ হবে। শুঁটকি তৈরির পর ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ এই তিন গ্রেডে ভাগ করা হয়। ‘এ’ গ্রেডের সকল শুঁটকি যায় বিদেশে। ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেড বিক্রি হয় দেশীয় বাজারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, নীলফামারী, বরিশালসহ দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এই শুঁটকি বাজারজাত হচ্ছে। মানভেদে ছোট আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতিমণ ১৬ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতিমণ ৩০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ব্যবসায়ী নান্নু হোসাইন বললেন, গত বছর তার চাতালে ৭শ’ মণ শুঁটকি তৈরি হয়েছে। সবই ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে গেছেন। মূলত ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে এই শুঁটকি বিদেশে যাচ্ছে। ঢাকার আশুলিয়ার ব্যবসায়ী জানালেন, এ ব্যবসায় লাভ-লোকসান দুই-ই আছে। শুঁটকি ভালোভাবে শুকানো না হলে পঁচে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
উন্নতমানের শুঁটকি কিনে বড় ব্যবসায়ীরা তা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করেন। মহিষলুটির ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ জানালেন, চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি বেশি স্বাদের। বিদেশে এ শুঁটকির চাহিদা বেশি। চলনবিলের শুঁটকির এত যে চাহিদা তারপরও প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই। যারা রপ্তানি করেন তারাই নিজের উদ্যোগে সংরক্ষণ ও প্যাকেটজাত করেন। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের কোন প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেই। শুঁটকি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপার সম্ভাবনার এ খাতটিকে এগিয়ে নিতে চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। মৎস্য অধিদপ্তর এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। একই সঙ্গে শুঁটকির মান উন্নয়নে চাতাল মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।