ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যশোরে লাখো মানুষের জনসভা 

নৌকায় ভোট চেয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮:১৯, ২৪ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৮:৪০, ২৪ নভেম্বর ২০২২

নৌকায় ভোট চেয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু প্রধানমন্ত্রীর

জনসভায় বক্তব্য দেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আবারও দেশবাসীর কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারের কাজ শুরু করলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

বিএনপির রটানো গুজবে কান না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির কাজই হলো সবময় মিথ্যাচার আর গুজব রটানো। এদের গুজবে কান দেবেন না। এরা যখনই ক্ষমতায় এসেছে লুটপাট করে খেয়েছে। হত্যা-সন্ত্রাস-রক্ত আর দুর্নীতি ছাড়া বিএনপি দেশকে কিছুই দিতে পারেনি। 

ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি, বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস-দুঃশাসন চালিয়ে দেশের মানুষের জীবন নিয়ে তারা ছিনিমিনি খেলেছে। যে দলের একজন (তারেক রহমান) মানিলন্ডারিং মামলায় সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত, ১০ ট্রাক অস্ত্রচোরাচালান মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। আরেকজন (খালেদা জিয়া) এতিমের টাকা মেরে খাওয়া মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। 

প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, যে দলের শীর্ষ দুই নেতাই সাজাপ্রাপ্ত, তারা কী দেশকে কিছু দিতে পারে? এরা দেশকে কিছু দিতে পারে না, শুধু মানুষের রক্ত চুষে খেতে জানে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও মানুষের কল্যান হয়- সেটি আমরা প্রমাণ করেছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই দেশের এতো উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দেশসেবার সুযোগ দিয়েছে বলেই আমরা দেশের এতো উন্নয়ন করতে পেরেছি। আগামী নির্বাচনেও আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। 

আগামী নির্বাচনে আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই, আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন। আবারও নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশসেবার সুযোগ দেবেন কিনা- বিশাল জনসমুদ্রের সামনে প্রধানমন্ত্রী এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে উপস্থিত উপস্থিত সর্বস্তরের লাখ লাখ মানুষ মুখে হ্যাঁ বলে এবং দু’হাত তুলে নৌকায় ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্যি আজ আনন্দিত। প্রায় তিন বছরের মাথায় আমার নানা যেখানে শুয়ে আছেন সেই যশোরে প্রথম জনসভায় যোগ দিতে পেরে সত্যিই খুব লাগছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করা, মানুষের কল্যাণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো ইনশাল্লাহ। যে দেশে একটি মানুষ না খেয়ে থাকবে না, কোন মানুষ ভূমিহীন বা গৃহহীন থাকবে না, সবার জন্য আমরা নিজস্ব ঠিকানা দেব। 

’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ সপরিবারে হত্যাকান্ডের কথা তুলে বঙ্গবন্ধুকন্যা আবেগজড়িত কন্ঠে বলেন, সব হারানোর বেদনা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পর দেশকে মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করা হলো, বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। হত্যা-ক্যু, ষড়যন্ত্র ও প্রতিরাতে কার্ফিউ। একেকটা ক্যুর পর শত শত সেনা অফিসারদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এই জিয়া-মুশতাক দু’জন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। বাবা-মা-ভাইদের হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকারটুকুও আমার ছিল না। তবে একটাই লক্ষ্য ছিল, যে জাতির জন্য আমার বাবা সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, সেই জাতির মুখে হাসি ফোটানো। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল বলেই দেশে উন্নতি সাধিত হয়েছে।

’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো দেশকে দুর্ভিক্ষের জাতিতে পরিণত করেছিল। মানুষের পেটে খাদ্য ছিল না, পরনে জামা ছিল না। সেখান থেকে দেশকে উন্নত করে আমরা দেশবাসীকে ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দিয়েছি। আজ সবার হাতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট- এসবই আওয়ামী লীগ দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি দেশকে কি দিয়েছে? হত্যা-রক্ত-সন্ত্রাস-দুর্নীতি ছাড়া তারা দেশকে কিছুই দিতে পারেনি। এই যশোরে কত সাংবাদিককে তারা হত্যা করেছে। ক্ষমতায় থেকে মানুষকে নির্যাতন করেছে আর মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।
 
বিএনপির শাসনামলে দেশের ভয়াবহ দুর্নীতি-দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের পর দেখানো হলো খালেদা জিয়া-তারেক- কোকোদের জন্য ভাঙ্গা-স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জী ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি। সেই যাদুর বাক্স এক সময় যাদুর বাক্স হয়ে গেলো, তারেক- কোকোরা হাজার হাজার কোটি টাকা মালিক হয়ে গেল, বিদেশে অর্থ পাচারের কারণেই তারা এখন সাজাপ্রাপ্ত। তিনি বলেন, মানিলন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানের ৭ বছরের কারাদন্ড এবং দুই কোটি টাকা অর্থদন্ড হয়েছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান করা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। ২১ আগস্ট আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা মামলায় সে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। আরেকজন (খালেদা জিয়া) এতিমের টাকা আত্মসাত করা জিয়া অরফানেজ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। যে দলের নেতারা সাজাপ্রাপ্ত, তারা দেশকে কী দিতে পারে? এরা দেশকে কিছুই দিতে পারে না, শুধু রক্ত চুষে খেতে পারে। 

বিগত নির্বাচনে যশোরের সব আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের নৌকায় ভোট দিয়ে দেশসেবার সুযোগ দেওয়ার জন্য যশোরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে। করোনার সময়ে বিশ্বের অনেক দেশগুলোতেও যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখনও আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখতে পেরেছি। রিজার্ভ নিয়ে কথা বলা হয়, ব্যাংকে নাকি টাকা নেই বলে গুজব রটানো হয়। আমাদের রিজার্ভ যথেষ্ট মজবুত আছে, প্রত্যেক ব্যাংকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ আছে। অনেক রেমিটেন্স আসছে, দেশে বিনিয়োগও বাড়ছে। সারা বিশ্ব যখন হিমসিম খাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। 

রিজার্ভ নিয়ে সমালোচনার জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, রিজার্ভ কোথাও যায়নি, মানুষের কল্যানেই লেগেছে। দেড়শ’ ডলারের গম আমাদের ৬শ’ ডলারে কিনতে হচ্ছে। আমরা আমদানি করছি যাতে যেন কোন ঘাটতি না থাকে। আর আমি বারংবার দেশবাসীকে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, কারোর এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। পতিত জমিতে যার যা ইচ্ছে উৎপাদন করুন। যাতে আমাদের কারোর কাছে হাত পেতে বা চেয়ে আনতে না হয়। তাই যে যা পারেন ঘাটতি মেটাতে নিজেরা উৎপাদন করুন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছেড়ে যায় তখন দেশের রিজার্ভ ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে সেই রিজার্ভ আমরা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পেরেছিলাম। তারা আবার রিজার্ভ নিয়ে কথা বলে! তিনি বলেন, করোনার সময় ভ্যাকসিন কেনা, চাল-গম-সার আমদানী করতে হচ্ছে। দেশের মানুষ যেন কষ্ট না পায়, ভাল থাকে সেজন্য খরচ করতে হয়েছে। রিজার্ভের টাকা মানুষের কল্যাণের জন্যই ব্যয় হচ্ছে। 

তিনি বলেন, বর্তমানে মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার, খালেদা জিয়ার আমলে যা ছিল মাত্র ৩৫৩ মার্কিন ডলার। কারণ খুন-হত্যা-নির্যাতন, লুটপাট ছাড়া তারা (বিএনপি) আর কিছুই করতে পারে না। খালেদা জিয়ার আমলে দেশের দারিদ্র্যর হার ৪০ ভাগের ওপরে চলে গিয়েছিল। আমরা তা ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মহামারী ও বৈশ্বিক সঙ্কট না দেখা দিলে দারিদ্র্যের হার আরও কমিয়ে আনতে পারতাম। 
শেখ হাসিনা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে কিংবা জার্মান উন্নত যে দেশের কথাই বলুন, সেখানে টাকা দিয়ে করোনার ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। 

মানুষের জীবন বাঁচাতে আমরা স্পেশাল বিমান পাঠিয়ে করোনার ভ্যাকসিন, সিরিঞ্জসহ সবকিছু কিনে এনে বিনা পয়সায় মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু গুচ্ছগ্রামের মাধ্যমে দেশের গৃহহীন-ভূমিহীনদের নিজস্ব ঠিকানা দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। আমরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাজ করে যাচ্ছি। ’৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে বলেছিলাম- দেশের কোন মানুষ কুঁড়ে ঘরে থাকবে না। এখন আমরা বিনা পর্যায় ভূমিহীন-গৃহহীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছি। এ পর্যন্ত ৩৫ লাখ গৃহহীন মানুষ ঘর ও নিজস্ব ঠিকানা পেয়েছে। দেশের একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না- যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আকাক্সক্ষা ছিল। তাঁর স্বপ্ন পূরণেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

পদ্মা সেতু বিনির্মাণের ফলে সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক পদ্মা সেতু নির্মাাণের ফলে সব কিছু পাল্টে গেছে। প্রত্যেক এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি। এই সেতু হওয়ার পর খুব দ্রæতই এ অঞ্চলের মানুষ যাতায়াত ও পণ্য সরবরাহ করতে পারছে। যশোর এয়ারপোর্টকে আরও আধুনিক করা হচ্ছে, যশোর থেকে কক্সবাজার বিমান চলাচলও শুরু হয়েছে। আমরা যশোরের অভয়নগরে ইপিজেড স্থাপন করে দিচ্ছি, সেখানে ৪শ’র মতো শিল্প স্থাপন হবে, বিপুল সংখ্যেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলযোগাযোগ ব্যবস্থাও আমরা গড়ে তুলবো।

দেশের যুব সমাজকে মাদক থেকে দূরে থেকে লেখাপড়া করে নিজেদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে এমন প্রত্যাশ্যা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুব সমাজের জন্য অনেক সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। তারা লেখাপড়া শেষ করে চাকুরির পেছনে না ছুটে নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্যও বিনা জামানতে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋন নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। কেউ যেন বেকার না থেকে কিছু না কিছু উপার্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। তাই যুব সমাজকে মাদক-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ দূরে থাকতে হবে। 

এসআর

সম্পর্কিত বিষয়:

×