ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

বিরাট অর্জনের দিন

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ১৯ অক্টোবর ২০২২

বিরাট অর্জনের দিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সংকটের কথা চিন্তা করে বিদ্যুৎ ব্যবহারে একটু মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে জ্বালানি খাতে কঠোরতা দেখাতে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও তার সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখবে। আমাদের কিছুটা সাশ্রয়ী হতে হচ্ছে, তার মানে এই নয় দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পাবে না। সকলে বিদ্যুৎ পাচ্ছে এবং পাবে। তবে এক্ষেত্রে সবাইকে একটু মিতব্যয়ী হতে হবে।
বুধবার পাবনার ঈশ্বরদীতে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (আরএনপিপি) ইউনিট-২ এর রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পারমাণবিক চুল্লির মূল কাঠামো) স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, তার সরকার পরিবেশ রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ফলে পরিবেশের কোন্্ ক্ষতি হবে না।
এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরাট অর্জনের দিন হিসেবে শনাক্ত হয়ে থাকবে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, অনেকেই সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু আমাদের তাদের সমালোচনায় কর্ণপাত করলে চলবে না, বরং আমরা দেশ ও জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্বটাই পালন করব। অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তাকেই তার সরকার প্রাধান্য দিয়েছিল। তার সরকারের অগ্রাধিকার ছিল দেশবাসীর জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে চেরনোবিলের মতো কোনো পারমাণবিক দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করা।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাবনার ঈশ্বরদী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, রাশিয়ার পরমাণু শক্তি সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান। অনুষ্ঠানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ার ফলে বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর, প্রধানমন্ত্রী আরএনপিপির প্রথম ইউনিটে আরপিভি উদ্বোধন করেছিলেন। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা প্রদানের জন্য রাশিয়ার সরকার ও প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য পারমাণবিক শক্তি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল সবাইকে বিদ্যুৎ দেওয়ার এবং আমরা সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছি। প্রতিটি ঘরে আলো জ্বেলে সমগ্র বাংলাদেশকে আমরা আলোকিত করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা এবং করোনাভাইরাসের কারণে মিতব্যয়ী হতে হচ্ছে কেননা আমদানির ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থায় মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি চলছে। এর ফলে আজকে উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে এবং তারাও সাশ্রয়ের দিকে নজর দিয়েছে। তাই প্রত্যেকেরই উপলব্ধি করা উচিত যে বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজ এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই বিশ^ব্যাপী চলমান মন্দার অভিঘাত বাংলাদেশেও যে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা জনগণকে খাদ্য নিরাপত্তা দিচ্ছি।

আমরা ন্যায্য মূল্যে খাবার কেনার জন্য এক কোটি মানুষকে বিশেষ কার্ড দিয়েছি এবং যারা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে অক্ষম তাদের বিনামূল্যে খাবার দিচ্ছি। তার সরকার অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে, কারণ তারা কোভিড-১৯ মহামারীর চ্যালেঞ্জ সফলভাবে অতিক্রম করেছে। তিনি বলেন, সরকার দেশবাসীর আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে, কারণ জাতির পিতা তাদের একটি সুন্দর জীবন দিতে তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
দেশে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ক্ষেত্রে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবদান রাখবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জনের দিন। এটা আমাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত সম্মান বয়ে আনবে। রূপপুর কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ আসবে, সেটা উত্তরবঙ্গের জন্যই ব্যবহার হবে। তারাই লাভবান হবে বেশি। সেখানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর্থসামাজিক উন্নতি হবে।
শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তির ব্যবহারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্র না, এটা একটা দৃষ্টান্ত যে আমরা এ ধরনের একটা কাজ করতে পারি। পরিবেশ ঠিক রেখে আমরা ২৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছি। যা আমাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে।
উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে ২০২১ সাল থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত যে পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বড় ভূমিকা রাখবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধু একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র না। পরমাণু ব্যবহার করা খুবই কঠিন। পরমাণু মানুষের কল্যাণের জন্য। বাংলাদেশ শান্তির জন্য এটা ব্যবহার করছে। এ প্রকল্প নির্মাণকালে সার্বিক নিরাপত্তার দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যসহ সবকিছু মাথায় রেখেই নির্মাণ কাজ চলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড পরিস্থিতির সময়ও রাশিয়ার বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পের কাজ বন্ধ করেনি। নিরাপত্তাসহ সব বিভাগেই কাজ অব্যাহত ছিল। সবার আন্তরিকতার কারণেই অত্যন্ত কঠিন এই কাজ আমরা করতে পেরেছি। এ কারণেই আজকের অগ্রগতি হয়েছে। আজকে সত্যিকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। যদিও ২০২১ সালে ১০ অক্টোবর প্রথম ইউনিটে প্রেসার ভেসেল স্থাপন করা হয়েছিল। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই দ্বিতীয় ইউনিটের  রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন করা হলো। এজন্য আমি রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের কর্মকর্তা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ যারা কাজ করছেন সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সরকারপ্রধান বলেন, প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ আর অন্ধকারে থাকবে না। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। যাতে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিটও চালু করার আশা রাখি। এর মাধ্যমে জলবায়ু সম্মেলনের যে সিদ্ধান্তটা ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঝুঁকিটা এতে পরিবেশের কোনো ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে না।

সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে মানুষকে দিতে পারব। এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ হবে। এটা আমাদের কোনো ক্ষতিই করবে না বরং মানুষ স্বচ্ছ একটা বিদ্যুৎ পাবে। মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি বড় অবদান রেখে যাবে। সে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আজকে এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরাট অর্জনের দিন হিসেবে শনাক্ত হয়ে থাকবে।

×