ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চালন লাইন তৈরিতে নজর নেই

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২১, ১২ অক্টোবর ২০২২

সঞ্চালন লাইন তৈরিতে নজর নেই

রূপপুর বিদ্যুত কেন্দ্রের লাইন তৈরির কাজ আগায়নি

গত এক যুগে দেশে বিদ্যুত সক্ষমতা ছাড়িয়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ তা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটের ওপরে। এ সময় নতুন করে ১২৭ বিদ্যুত কেন্দ্রও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সক্ষমতা ও চাহিদার বিপরীতে সঞ্চালন লাইন একেবারেই নগন্য। ফলে বড় বড় কেন্দ্র চালু হলেও শুধু সঞ্চালন লাইন না থাকার কারণে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাচ্ছে না এসব কেন্দ্রের বিদ্যুত।

বিদ্যুত উৎপাদনের পাশাপাশি সঞ্চালন লাইনের প্রতি নজর দেয়া হলে সাম্প্রতিক বিদ্যুত সঙ্কট এতটা তীব্র হওয়ার আশঙ্কা কম ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুত সাশ্রয়ে কৃচ্ছ্র নীতি গ্রহণের সময় সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে ভারত থেকে আমদানি করা আদানির বিদ্যুত। এছাড়া  পায়রা-গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কিলোভোল্ট (কেভি) ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি চলে এলেও এর কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন। এটির কাজ শেষে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত যোগ হতে নবেম্বর পার হয়ে ডিসেম্বর হয়ে যেতে পারে বলেও জানান তিনি। তবে আদানির জন্য সঞ্চালন লাইন তৈরি থাকলেও বিদ্যুত কেন্দ্রটিই বিদ্যুত চুক্তি অনুসারে অক্টোবর থেকে দিতে পারেনি জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের বিদ্যুত পেতেও জানুয়ারি হয়ে যাবে।

এদিকে রূপপুর তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের একবিন্দু কাজও হয়নি। তাই এটি থেকে বিদ্যুত উৎপাদিত হলেও তা জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ার দ্রুত কোন সম্ভাবনা নেই। শুধু সঞ্চালন লাইন তৈরি না হওয়ার কারণে জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যাচ্ছে না রামপালের বিদ্যুতও। তবে এই কেন্দ্র থেকে জানুয়ারি নাগাদ বিদ্যুত পাওয়ার আশা করছে বিদ্যুত বিভাগ।
সব মিলিয়ে বিদ্যুত পরিস্থিতি এবার আগামী বছরের জানুয়ারির আগে ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না উল্লেখ করে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের একটি ইউনিট চালিয়ে যে বিদ্যুত উৎপাদিত হয় তা সরাসরি চলে যায় গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে বিতরণ হয় তাদের সাবস্টেশনে। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত এই বিদ্যুত সরবরাহ করা হচ্ছে।

আমরা আশা করেছিলাম সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই সঞ্চালন লাইনটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। ফলে এখান থেকে বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পারব। কিন্তু এখন এটি ডিসেম্বরের আগে হচ্ছে না। এখান থেকে বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ডিসেম্বরে তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বিদ্যুত কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলছি। সব মিলিয়ে নতুন বছরের শুরু বিদ্যুতের জন্য শুভ হবে বলেই আমরা আশা করছি।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, বিতরণ সংস্থা পর্যন্ত বিদ্যুত পৌঁছতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা নিরসনে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ২১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারীসহ নানা জটিলতায় তা পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয় এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষে বর্তমান সক্ষমতার সঙ্গে আরও নতুন ১১৭টি গ্রিড উপকেন্দ্র সংযুক্ত করার কথা ছিল। আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মিত হবে। যার জন্য ২০২৮ সালকে টার্গেট করা হয়েছিল।
এ লক্ষ্যেই আরও আটটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগের কথা জানিয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতা কাটাতে গত এক দশকে ৫৪টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে পিজিসিবি। এর মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে ২৫টি। চলমান রয়েছে ২১টি প্রকল্পের কাজ। আরও আটটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। যেগুলোর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৮ সাল নাগাদ। চলমান ও পরিকল্পনাধীন প্রকল্পগুলো শেষ হলে দেশে বিদ্যুত সঞ্চালনের দুর্বলতা অনেকটাই কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি।

এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণের রাইট অব ওয়ে প্রাপ্তিসহ সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিজিসিবি এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে অন্তর্বর্তীকালীন কার্যক্রম এবং স্থায়ীভাবে দূর করতে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যেগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িত হবে।
পিজিসিবি কর্তৃপক্ষ বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ময়মনসিংহ, ভালুকা ও নেত্রকোনা ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্রের লো-ভোল্টেজজনিত সমস্যা রয়েছে। জিটুজি প্রকল্পের আওতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ ১৩২ কেভি ডাবল সার্কিট লাইনের ক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।

এ অবকাঠামো নির্মিত হলে ভবিষ্যতে  লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হবে না বলে দাবি করে পিজিসিবি বলছে, লো-ভোল্টেজ সমস্যা নিরসনে পিজিসিবির নিজস্ব অর্থায়নে ময়মনসিংহ, ভালুকা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ১৩২/৩৩ কেভি উপকেন্দ্রে ক্যাপাসিটর ব্যাংক স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ কালিয়াকৈর-শম্ভুগঞ্জ ৪০০ কেভি লাইন এবং শম্ভুগঞ্জ ৪০০/১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণে মাঠ পর্যায়ের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে। আর চলমান রয়েছে শ্রীপুর ২৩০/৩৩ কেভি উপকেন্দ্র ও শ্রীপুর-ভালুকা ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ।
এছাড়া, পূর্ব সাদীপুর ২৩০/১৩২ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র এবং বড়পুকুরিয়া-পূর্ব সাদীপুর ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সাল নাগাদ। পার্বতীপুর ২৩০ কেভি সুইচিং স্টেশন, রংপুর ২৩০/১৩২ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র এবং বড়পুকুরিয়া-রংপুর ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ ২০২৩ সালের শুরুতে শেষ হবে। আর বগুড়া-পার্বতীপুর ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। এসব প্রকল্প শেষ হলে রংপুর বিভাগে বিদ্যুত সরবরাহে নিরবচ্ছিন্নতা বাড়বে বলে দাবি পিজিসিবির।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের বিষয়টি পিজিসিবির একক নিয়ন্ত্রণে। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোয় কিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করলেও সঞ্চালন ব্যবস্থার সার্বিক কর্তৃত্ব পিজিসিবির কাছেই। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এসব প্রকল্পের অধিকাংশই স্থবির হয়ে পড়ে। কোভিডকালে বিদেশী কর্মীদের প্রকল্প এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা কারণে এ সঙ্কট প্রলম্বিত হয়।

শুধু তাই নয়, প্রকল্পের সমীক্ষা যাচাই, পরামর্শক নিয়োগ, দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার নির্বাচনেই চলে গেছে নির্ধারিত সময়ের সিংহভাগ। তাই এখন এই সঙ্কটকালীন সময়ে সঞ্চালন লাইনে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে পারলেও সঞ্চালন লাইন সেভাবে উন্নত করা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সঙ্কটে আমরা দেখছি প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন থাকলে সঙ্কট অনেকটাই কাটত বিদ্যুতের।

×