ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কর্মসংস্থান

সঙ্কট কাটছে শিক্ষায়

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২; আপডেট: ২৩:১৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

সঙ্কট কাটছে শিক্ষায়

প্রাথমিকে নিয়োগ হচ্ছে ৪৫ হাজার শিক্ষক

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ধকল সামলে বন্ধ হওয়া বেসরকারী স্কুলগুলোতে শুরু হয়েছে পাঠদান। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফিরেছেন শিক্ষকও। সরকারী ও আধাসরকারী পর্যায়ের স্কুল-কলেজেগুলোতেও বিপুল শিক্ষক নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। নতুন করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আগমনে শিক্ষায় সুদিন ফিরে আসছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কর্মসংস্থান।
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল দীর্ঘ সময়। এ সময় সরকারী-আধাসরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধির কারণে পেছানো হয় প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা। নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও করোনায় চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও।

একে একে বন্ধ হয়ে যায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বেতন না দেয়া ও প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে অনেক শিক্ষক পেশা বদলে ফেলেন। তবে করোনায় শিক্ষার কর্মসংস্থানে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল, তা শুকাতে শুরু করেছে। আগামী বছরের শুরুতেই সরকারী প্রাথমিকে ৪৫ হাজার শিক্ষক যুক্ত হবেন। এনটিআরসিএ এ বছরের অক্টোবরে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। এবার ৭০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে সংস্থাটি।
প্রাথমিকে যোগ দিচ্ছে ৪৫ হাজার শিক্ষক ॥ সহকারী শিক্ষকের ৩২ হাজার ৫৭৭টি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ২০২০ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। করোনা মহামারীর কারণে নিয়োগ পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই দুই বছরে অবসরজনিত কারণে ১০ হাজারেরও বেশি সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য হয়। ফলে আগের বিজ্ঞপ্তির শূন্য পদ ও বিজ্ঞপ্তির পরের শূন্য পদ মিলিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যার নিয়োগ কার্যক্রম একেবারেই শেষ পর্যায়ে আছে।

সূত্র জানায়, আগামীকাল ২ অক্টোবর প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদে মৌখিক পরীক্ষা শেষ হবে। এর পর বুয়েটে পরীক্ষার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর পাঠানো হবে। সেখান থেকেই প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে নবেম্বরে এই পদের ফল ঘোষণা করা হবে। বর্তমানে সারাদেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এতে অনুমোদিত শিক্ষকের পদ ৪ লাখ ২৮ হাজার ৭০১টি। ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষকদের যোগদানের ফলে প্রাথমিকের শিক্ষক সঙ্কট নিরসন হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর জানায়, সারাদেশে অনুমোদিত পদের চেয়ে ৩৭ হাজার সহকারী শিক্ষক কম। এ ছাড়াও ৫-৭ হাজার শিক্ষক প্রতিবছর অবসরে যাচ্ছেন। নতুন নিয়োগের ফলে সঙ্কট কেটে যাবে। এবার শিক্ষক পদায়নের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করা হবে। উপজেলাভিত্তিক নিয়োগের কারণে শিক্ষকদের নিজ নিজ উপজেলায় পদায়ন করা হয়।

এবার কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যাবে। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় নিজ উপজেলার বাইরেও সমন্বয় করে পদায়নের পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকে মূল সঙ্কট শিক্ষক নয়, বড় আরও দুই সমস্যা হলো শিক্ষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পদায়ন ও বদলি। এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ চলছে, যা বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিক শিক্ষার মূল সঙ্কট দূর হবে। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর এ সব সঙ্কট সমাধানে কাজ করছে।
এনটিআরসিএর মাধ্যমে ৭০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ॥ দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুল ও কলেজের শূন্য পদের শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করেছে এনটিআরসিএ। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) প্রায় ৭০ হাজার শূন্য পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে যাচ্ছে। এর আগে দেশের বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় একসঙ্গে এত বেশি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। সে অনুযায়ী এবার চতুর্থ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে যাচ্ছে তারা। সর্বশেষ গত বছরের ৩০ মার্চ এনটিআরসিএ ৫৪ হাজার ৩০৪টি শূন্য পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এর মধ্যে অন্তত ৪০ ভাগ ইনডেক্সধারী শিক্ষক থাকায় এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক ঘাটতি থেকেই গেছে।
শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়োগ শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি জেলার শূন্য পদের চাহিদা আসার পর তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। সে অনুযায়ী এবার বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৭০ হাজার শূন্য পদ রয়েছে। এ সব পদের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হলে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এবার শিক্ষক আবেদনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রতি স্কুলে ১০০ টাকার বিনিময়ে আবেদন করা যেত। ফলে হাজারো স্কুলে আবেদনে লাখ টাকা ব্যয় করতেন চাকরিপ্রার্থীরা। এই সঙ্কট সমাধানে এবার হাজার টাকার বিনিময়ে ৪০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করা যাবে।
এনটিআরসিএ সচিব ওবায়দুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুল ও কলেজের শূন্য পদের শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ শেষ। শিক্ষা, মাদ্রাসা ও কারিগরি অধিদফতরে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এ তালিকা পাঠানো হয়েছে। তালিকা আসলে প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মতি আছে।
কিন্ডারগার্টেনে ফিরছে সুদিন ॥ বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকতা পেশা নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল করোনা মহামারীতে। এ সময় কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকতা ছেড়ে কেউ সবজি বিক্রেতা হয়েছিলেন, কেউ আবার গ্রামে ফিরে চাষবাস শুরু করেছেন। ওই সময় তিন শিক্ষকের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছিল। করোনার সময় ৭০ ভাগ শিক্ষক পেশা ছেড়েছিলেন বেতন না পাওয়া, অনিশ্চিত ভবিষ্যতসহ নানা কারণে। সুখবর হলো- মহামারীর সঙ্কট কেটে যেতেই ৭৫ ভাগ শিক্ষক আবার এই পেশায় ফিরে এসেছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, সারাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ৬০ হাজার। শিক্ষক সংখ্যা ১০ লাখ। কর্মচারী আছে প্রায় দেড় লাখ। এক কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে এখানে। সরকারী বিধি-নিষেধ ও নানা কারণে করোনার সময় ১২ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়।   ১০ লাখ শিক্ষকের মধ্যে তিন লাখ শিক্ষক এই পেশায় আর ফিরে আসেননি।  
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেতন কম হওয়ায় বেকার বা শিক্ষার্থীরা চাকরি করেন এ সব স্কুলে। অভিযোগ আছে, দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল কিন্ডারগার্টেন স্কুল। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ না থাকা ও  ছোট ঘরে পাঠদানের কারণে এ সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সমালোচনার শেষ নেই। এর মধ্যেও শিক্ষার্থীদের থেকে নিয়মিত পাঠ আদায়ের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নাম করছে। চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা রাজধানী ও মহানগরে বেশি ছিল। এখন গ্রামপর্যায়েও এর বিস্তার বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জি এম জাহাঙ্গীর কবির রানা বলেন, শিক্ষক সংখ্যা ৮০ ভাগ পূরণ হলেও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। গ্রামপর্যায়ের প্রাথমিকেও কিছু শিক্ষার্থী চলে গেছে। বেতন কাঠামো না থাকায় এই পেশায় যারা আসেন, তাদের অধিকাংশই বেকার। অনেকের বেতন ৬ হাজার। আবার অনেকে ৩৫ হাজার টাকাও বেতন পান। তবে শিক্ষার্থীদের টিউশনে ও কোচিংয়ের মাধ্যমে এ সব শিক্ষকের অর্থ উপার্জনের কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, করোনায় পঙ্গু অবস্থা হয়েছিল কিন্ডারগার্টেনের। তবে এখন অপেক্ষাকৃত ভাল সময় পার করছে। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীও ফিরে আসছে এ সব স্কুলে।

×