
ভেনামি চিংড়ি চাষে আরও গবেষণার তাগিদ
দেশে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনে বিস্তর গবেষণার তাগিদ দেয়া হয়েছে। নতুন প্রজাতি ভেনামি উৎপাদন করতে গিয়ে জিআই-সনদপ্রাপ্ত বাগদার উৎপাদন ও রফতানি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখার ওপর সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে এ খাতের উদ্যোক্তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দ্রুত ভেনামি চিংড়ি চাষের সুযোগ প্রদান ও রফতানির অনুমতি চেয়েছেন।
ভেনামি চিংড়ি চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই, ভবিষ্যত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের আটটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয় মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পুকুরে চাষকৃত ভেনামি চিংড়ি আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রাথমিক সমীক্ষায় দেশে ভেনামি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে মাটি, পানি, আবহাওয়া, জলবায়ু ও জনজীবনের ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে সেটি নিয়ে আরও গবেষণার ওপর জোর দেয়া হয়।
ভেনামি চিংড়ির জাতটি উচ্চ ফলনশীল ও উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বাগদা এবং গলদা চিংড়ির চেয়ে কম। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে খুলনার পাইকগাছায় ২০১৮ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষের অনুমতি দেয়া হয়। তবে নানা জটিলতা ও কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর চাষ শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
সর্বশেষ গত বছর মার্চ থেকে পাইকগাছা উপজেলায় অবস্থিত নোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু করে যশোরের এমইউ সি ফুডস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণলায়ের সচিব ড. মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে ভেনামি চিংড়ি আনুষ্ঠানিকভাবে আহরণ করা হয়। মাত্র ৮৮ দিনে ২৮-৩০ গ্রাম ওজন হয়েছে প্রতিটি চিংড়ির।
অল্প সময়ের ব্যবধানে ফলন ভাল হওয়ায় খুশি এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, ভেনামির যে চাষ হচ্ছে, সেটা পাইলট প্রকল্পের ভিত্তিতে। তবে ফলন ভাল হলেও এটা নিয়ে এখনই খুশি হওয়ার মতো কারণ নেই। অতীতে বিদেশী জাত রেইন ট্রি ও ইউক্লিপটাস গাছের চারা লাগিয়ে বিপদের মুখে পড়েছিল দেশ। এই গাছগুলো মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়াসহ মানুষের জীবন ধারণের অক্সিজেন পর্যন্ত খেয়ে ফেলত।
অর্থাৎ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তীতে গাছগুলো কেটে ফেলতে হয়েছে, কিংবা রোপণ না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত গবেষণা ও দীর্ঘমেয়াদে কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এ ধরনের কোন স্টাডি না থাকায় বিদেশী এই গাছগুলো নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। ঠিক একইভাবে ভেনামি বিদেশী জাতের চিংড়ি দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য উপযুক্ত কিনা, চাষাবাদে বাগদা ও গলদা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে কি না সে সব বিষয় নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন।
হুট করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সরকারের জন্য কঠিন বিষয়। তিনি বলেন, বাগদা আন্তর্জাতিকভাবে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য- বা জিআই সনদপ্রাপ্ত হয়েছে। এটি দেশের জন্য বিরাট অর্জন এবং গর্বের। অন্যদিকে বিদেশী ভেনামি যারা চাষ করছেন তারা নির্দিষ্ট জোন বা এলাকার মধ্যে করতে পারছেন। কিন্তু জায়গা স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে এ ধরনের জোন করা সম্ভব নয়। ভেনামি চিংড়ির চাষ, সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই এবং ভবিষ্যত ঝুঁকি নিরূপণে দুটো কমিটি কাজ করছে। তিনি জানান, বহির্বিশ্বে ভেনামির বাজার বড় হচ্ছে এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে। তবে ঝুঁকি কতটা মোকাবেলা করা যাবে সেটিও গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদন পাওয়া আটটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে খুলনায় ছয়টি ও কক্সবাজারের দুটি। যদিও ১৬টি প্রতিষ্ঠান ভেনামি চাষের জন্য মৎস্য অধিদফতরে আবেদন করেছিল। কিন্তু চাষের পরিবেশ ও অবকাঠামো না থাকায় আটটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। অনুমতি পাওয়া আটটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- এমইউসি ফুডস, ফাহিম সি ফুডস, গ্রোটেক এ্যাকোয়াকালচার লিমিটেড, রেডিয়েন্ট শ্রিম্প কালচার, আইয়ান শ্রিম্প কালচার, ইএফজি অ্যাকোয়া ফার্মিং, জেবিএস ফুড প্রডাক্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও প্রান্তি অ্যাকোয়া কালচার লিমিটেড।
এর মধ্যে চলতি বছরের মে মাসে এমইউসি ফুডস থাইল্যাল্ড থেকে ১২ লাখ ভেনামি জাতের পোনা আমদানি করে পাইকগাছার লবণ পানি গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে চাষ শুরু করেছে। এ ছাড়া অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে সাতক্ষীরার দেবহাটার আলহেরা মৎস্য প্রকল্প, খুলনার রূপসার ফ্রেস ফুডস লিমিটেড ও জেমিনি সি ফুডস লিমিটেড এবং সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের নলতা আহসানিয়া ফিশ লিমিটেড। অবকাঠামো সংস্কার হলে দ্রুত এই চারটি কোম্পানিকেও ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়া হবে।
বিএফএফইএ ও মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে, ভেনামির ফলন পাওয়া যায় ৯০-১০০ দিনের মধ্যে। যেখানে বাগদা চিংড়ির ফলন পেতে হলে দরকার হয় ১৪০-১৬০ দিন। ভেনামি উচ্চ ফলনশীল বলে চায়না, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়া ও মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে এটির চাষ হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি রফতানি করছে ভারত। বিশ্বে প্রায় সাড়ে ৪৫০ প্রজাতির চিংড়ি আছে এবং বাংলাদেশেই আছে প্রায় ২৭টি প্রজাতি। তবে বাগদা, চাকা, হরিণা ও গলদাই বাংলাদেশে বেশি চাষ হয়।
এ প্রসঙ্গে এমইউ সি-ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জনকণ্ঠকে বলেন, নোনাপানি কেন্দ্রের ছয়টি পুকুরে ভেনামি চিংড়ি চাষ করা হয়। গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এ বছর আরও বেশি চিংড়ি উৎপাদন করা হয়েছে। রফতানি ও বিদেশী ক্রেতা টিকিয়ে রাখতে ভেনামির কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আগামী ২০২৬ সাল নাগাদ ভেনামি চিংড়ির বিশ্ব বাজার দাঁড়াবে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার।
বিগত দুই দশক যাবত বিশ্বে ৬২টি দেশে উচ্চ ফলনশীল ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছে এবং বিশ্বে সর্বমোট চিংড়ি উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ ভেনামির চিংড়ি। শুধু তাই নয়, বর্তমান বিশ্বের চাষ মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদনকারী ৬২টি দেশ ভেনামি চিংড়ি চাষ করে এবং এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতীত ১৪টি দেশই বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চাষ করে থাকে।
দেশে ভেনামির চাষ ও রফতানির অনুমতি দেয়া না হলে এ খাত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। স্বল্প খরচে এবং স্বল্প সময়ে ভেনামি চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব যেটা বাগদা কিংবা গলদা চিংড়ি করে কোনভাবেই সম্ভব নয়। এ কারণে চিংড়ি রফতানিতে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই আমাদের ভেনামিতে যেতে হবে।
দেশীয় চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ায় ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমোদন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এ্যাসোসিয়েশন প্রায় ১২ বছর ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছে। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশী এই চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়। এদিকে ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। মৎস্য অধিদফতর এই অঞ্চলের ৪টি চিংড়ি হ্যাচারিকে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-কক্সবাজারের উখিয়ার এমকে হ্যাচারি, কলাতলী এলাকার নিরিবিলি হ্যাচারি ও খুরুশকুল এলাকার মিডওয়ে সাইন্টফিক ফিশারিজ লিমিটেড ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ডাফা ফিড অ্যান্ড এ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড। উদ্যোক্তারা বলছেন, বাগদা চিংড়ি চাষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আরও ৮-৯ বছর আগেই সরকারের উচিত ছিল অধিক উৎপাদনশীল ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমোদন দেয়া। প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এখন অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশে এখন পরীক্ষামূলক চাষের অনুমোদন পাচ্ছে। আর প্রতিবেশী দেশগুলো ভেনামি চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা শুধু বাগদা ও গলদা চিংড়ি রফতানি করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। সরকার ভেনামি চাষ উন্মুক্ত করে দিলে চিংড়ি রফতানি শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। সর্বশেষ চলতি ২১-২২ অর্থ বছরে চিংড়ির নিয়মিত গ্রোথ এবং রোগবালাই অনুসন্ধানে নমুনা পরীক্ষায় মনে করা হয়, ভেনামির রোগ প্রতিরোধ এবং জীবনধারণ ক্ষমতা বাগদার তুলনায় বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পোনা ছাড়ার পর থেকে সাত সপ্তাহ পর্যন্ত চিংড়িতে রোগবালাই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাদের মতে, ভেনামির পোনা ছাড়ার পরের ৬৮ দিনে গ্রোথ ও ফার্টিলিটি রেট খুবই আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, কাঁচামাল হিসেবে চিংড়ির অভাবে মাছ কোম্পানিগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। দেশে উৎপাদিত চিংড়িতে যে কয়টি কোম্পানি চালু আছে সেগুলোর সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১৮-২০ শতাংশ চাহিদা মিটছে।
ফলে প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচও িেশ হচ্ছে। তবে ভেনামি চাষে আশার কথা হলো, প্রতি হেক্টরে যেখানে বাগদার উৎপাদন ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কেজি, সেখানে একই পদ্ধতিতে ভেনামির উৎপাদন হেক্টর প্রতি উৎপাদন ১০ হাজার কেজি থেকে ২০ হাজার কেজি পর্যন্ত সম্ভব। এক্ষত্রে প্রতি স্কয়ার মিটারে যেখানে বাগদার ১৫-২৫ টির বেশি পোনা অবমুক্ত করা যায় না, সেখানে ভেনামি প্রতি স্কয়ার মিটারে ৪০-১৫০টি পর্যন্ত অবমুক্ত করা যায়।
সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মোঃ আমিন উল্লাহ জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা ও গলদা চিংড়ির যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তবে সমস্যা হলো উচ্চ ফলনশীল সস্তা দামের ভেনামি চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমরা মোটেও প্রতিযোগী নই। এ কারণে এ খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশী বাজার হারাচ্ছে।