বিমানের ফ্লাইটে যেতে না পেরে শাহজালাল বিমানবন্দরে কান্নায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন আফগান তরুণী হুসনা
রাত তখন সাড়ে দশটা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমান কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন ২৪ বছর বয়সী আফগান তরুণী সেফারি আহমেদি হোসনা। তার কান্না দেখে দূর থেকে সবাই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। বিমানের কাউন্টার থেকেও একজন দেখে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জানতে চান ‘হোয়াই বিমান অফলোডেড মি? হোয়াটস মাই ফল্ট?’
কেউ যখন তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিলেন না, তখন এ প্রতিনিধি জানতে চান বিমান কাউন্টারে। বিমান জানায়, হোসনা যাবেন কাবুল। বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে আবুধাবী যাবেন, সেখান থেকে অন্য একটি এয়ারে কাবুল যাবেন। কিন্তু চেক ইন কাউন্টারে ওই যাত্রীর টিকেট আবুধাবী থেকে কাবুল পর্যন্ত অনলাইন সিস্টেমে দেখাচ্ছিল না। এ কারণেই তাকে বোর্ডিং কার্ড দেয়া যায়নি। বিমানের এ ব্যাখ্যা নিয়ে জানতে চাওয়া হয় পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ও মহাব্যবস্থাপক আজিজুর রহমানের কাছে। তখন তাদের নির্র্দেশনা পেয়ে বিমানের কর্মকর্তাদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। শেষ মুহূর্তে তাকে ফ্লাইটে তোলার চেষ্টা করেন।
কিন্তু ততক্ষণে ফ্লাইটে পুশ কার্ট লাগানো হয়। এ খবর শুনে মেয়েটি মুহূর্তেই সজোরে প্রশ্ন রাখেন, বিমান কেন এমন করল? এ কথা বলেই অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এ ঘটনা বৃহস্পতিবার রাতের। এ সময় ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিভিল এভিয়েশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহেল কামরুজ্জামান ও দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি।
এদিকে, শুক্রবার দিনভর বিমানের পরিচালক (গ্রাহকসেবা) মোঃ সিদ্দিকুর রহমান ও মহাব্যবস্থাপক আজিজের সার্বক্ষণিক তদারকিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে মেয়েটির অনুমতি নেয়া হয়, যাতে ট্রানজিট যাত্রীর প্রাধিকার হিসেবে আবুধাবিতে তার কাছে কোন ভিসা চাওয়া না হয়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সারাদিন চলে যায়। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যায় তার অনুমতি আসে দুবাই থেকে। তিনি আজ শনিবার বিকেল ৫টায় বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা ছাড়বেন।
জানা গেছে, হোসনা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের মেয়ে। নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের চব্বিশ বছর বয়সী এই মেয়ে মাস চারেক আগে বাংলাদেশে আসেন চট্রগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে উচ্চশিক্ষা নিতে। কিছুদিন পড়াশুনা করার পর এখানকার খাবার-দাবার ও পরিবেশের কারণে তার পেটে জটিল ব্যাধি দেখা দেয়। আবার চোখের একটি কর্নিয়াও নষ্ট হয়ে যায়। এসব কারণে তিনি আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য টিকেট কাটেন বিমানের। ঢাকা থেকে আবুধাবি হয়ে সেখান থেকে কাবুল পর্যন্ত অন্য একটা এয়ারলাইন্সে যাবেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানববন্দরে বিমানের চেকইন কাউন্টারে যাওয়ার পর তার অনলাইন টিকেটে আবুধাবি পর্যন্ত ঠিক দেখালেও সেখান থেকে কাবুল পর্যন্ত কোন তথ্য-উপাত্ত না থাকায় বোর্র্র্ডিং কার্ড দেয়া হয়নি।
এ সময় হোসনা চ্যালেঞ্জ করে যু্িক্ত দেখান, ঢাকা থেকে কোন এয়ারলাইন্সের সিস্টেমেই কাবুল পর্যন্ত প্রদর্শন করে না। তাকে যেতে দেয়া হলে আবুধাবিতে দু’ঘণ্টার ট্রানজিট সময়েই সিস্টেমে কাবুল পর্যন্ত এসে যায়। হোসনার কোন ওজর-আপত্তি না নিয়ে বিমান তাকে এড়িয়ে চলে। এ সময় তিনি বিমানের কাউন্টারের সামনে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তখন তাকে এয়ারপোর্ট ওয়েলফার রেস্টুরেন্টে নিয়ে সেবা শুশ্রƒষা করেন বিমানের কেবিন ক্রু ফ্লোরা ও এয়ারপোর্ট স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নূরনবী টিপু। তখন এ প্রতিনিধি বিষয়টি বিমানের উর্ধতন মহলের নজরে আনার পরই শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। চেকইন কর্মকর্তা শাহজাহান ছুটে এসে হোসনার সঙ্গে কথা বলে রাত তিনটায় ইতিহাদের ফ্লাইটে পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে রাত একটা পর্যন্ত বিমানবন্দরে চলে হৈচৈ। দেড়টার দিকে তাকে বিমানবন্দর থেকে বনানী ডরমিটরিতে ফিরিয়ে নেন তার ইউনিভার্সিটির প্রতিনিধিরা।
এদিকে, শুক্রবার দিনভর চেষ্টা করে বিমানের পরিচালক সিদ্দিকুর রহমানের নির্দেশে মহাব্যবস্থাপক আজিজুল ইসলাম ঢাকা থেকে আবুধাবি ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোন ধরনের অনুমতি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত দুবাই রুটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে কাবুল যেতে চাইলে সেখানে ট্রানজিট ভিসা চাওয়া হয় না। এ বিষয়ে মহাব্যবস্থাপক আজিজুল ইসলাম বলেন, আবুধাবি বিমানবন্দরে এ ধরনের যাত্রীদের ট্রানজিট ভিসা চাওয়া হয়। কিন্তু হোসনার তো সেটা নেই। তাই তাকে টিকেট রিরুট করে আজ শনিবার বিকেল পাঁচটায় দুবাই পাঠানো হবে। সেখান থেকে বাজেট এয়ারের একটা টিকেটে মেয়েটি কাবুল যেতে পারবেন।