
মোরসালিন মিজান ॥ প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে...। কবি আর নেই। চলে গেছেন। তবে তার প্রিয় চালতা ফুল ফুটছে সময়মতোই। কবি দেখতে পারছেন না। দেখতে যে পারবেন না, আগে থেকেই জানতেন। তাই কবিতায় সেই বিচ্ছিন্নতার কষ্টের কথা আগাম লিখে গিয়েছিলেন। একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে বিষ্ণু দে লিখেছিলেন : আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে...। না, শুধু কবিদের নয়। সৌন্দর্যপ্রেমীদের এ ফুল বহুকাল ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে।
সবুজ পাতার আড়ালে মুখ লুকানো অনিন্দ্য সুন্দর ফুল চালতা। আর সব ফুল থেকে আলাদা। গাছ অনেক বড় ও উঁচু হয়। ফুলের আকারও বাগানের ফুলের মতো নয়। বেশ বড়। আর ফুলের সৌন্দর্য লিখে বোঝানো তো মহা মুশকিলের কাজ। আশ্চর্য সুন্দর ফুল। প্রকৃতি আলাদা যতেœ একে গড়ে নিয়েছে বলেই মনে হয়। একসময় দেশের বেশিরভাগ গ্রামেই চালতা গাছ চোখে পড়ত। বাড়ির পেছনের ঝোপজঙ্গল থেকে উঁকি দিত চালতা। তবে অতিচেনা গ্রামীণ এ বৃক্ষ এখন কিছুটা দুর্লভ। সংখ্যাটা দিন দিন কমছে।
চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কিছু দেশে হয়। বিশেষত এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এ কারণেই বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইন্ডিকা শব্দটি ইন্ডিয়া থেকে নেয়া। আর ডিলেনিয়া নামটি নেয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত তরুবিদ জে জে ডিলেনিয়াসের নাম থেকে। চালতার ইংরেজী নাম এলিফ্যান্ট এ্যাপেল। বাংলাদেশে চালতাকে চালিতা, চাইলতে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
চালতা ফুলের সাদা পাঁচটি পাপড়ি। বেশ মোটা ও মাংসল। গোলাকার ফুলের পরাগকেশর অসংখ্য। দৃষ্টিনন্দন ফুল কয়েকটি পর্যায়ে নিজেকে বিকশিত করে। ক্রমে বাড়তে থাকে সৌন্দর্য। পাতার সৌন্দর্যও বলে শেষ করা যাবে না। আয়তাকৃতি পাতার খাঁজকাটা আউটলাইন। করাতের দাঁতের মতো দেখতে। ভয়ঙ্কর নয় মোটেও। মনে হয়, কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে চমৎকার নক্সা করে দিয়েছে। পাতার শিরা উঁচু। সমান্তরাল।
গ্রামে অযত্নে থাকলেও, শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে চালতা গাছ লাগানো হয়। এমনকি রাজধানী ঢাকায় কিছু গাছ আছে। মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেনে আছে। আছে শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের পেছনের অংশে। বেইলি রোড সংলগ্ন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ ভবনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে আছে একটি গাছ। একটু অনুসন্ধিৎসু হলে আরও দেখা যাবে।
উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, মধ্যমাকৃতি চিরহরিৎ বৃক্ষ চালতা। উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শাখা-প্রশাখা এলোমেলো। বাকল লালচে মসৃণ। গাছের আয়ু মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। পাতা ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয়। বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। ফুলের ব্যাস হয় ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। বৃতির সবুজ, দলের শুভ্রতা, পরাগের হলুদ ও তারকাবৃতি গর্ভমু--সব মিলিয়ে চালতা ফুলের গড়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
ফলের জন্যও পরিচিতি আছে চালতার। এর বৃতিই এক সময় ফলে রূপান্তরিত হয়। টক স্বাদের ফল গ্রামীণ নারীরা ভীষণ পছন্দ করেন। লবণে মেখে নিয়ে গল্প করতে করতে খান। শরত, হেমন্ত ফল পাকার সময়। শীতকাল পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। চালতার ফল হয় টকমিষ্টি। আচার, চাটনি, টক ডাল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। পাকা ফল পিষে নিয়ে লবণ, কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। চালতার শাঁস নানা খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। জেলি ও শরবত তৈরি হয় চালতা ফল থেকে। চালতার শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি হয় নৌকা। সব মিলিয়ে চালতা বেশ উল্লেখযোগ্য একটি গাছ।