
মোরসালিন মিজান ॥ প্রাচীন বাংলা মানে, শত শত বছর আগের বঙ্গদেশ। নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ বঙ্গভূমি তখন বিদেশীদের বিশেষ আকর্ষণ করেছিল। বণিক বেনিয়াদের কথা তো আমরা জানিই। এর বাইরেও অনেক পর্যটক ধর্মযাজক শিল্পী সাহিত্যিক প্রাচীন বাংলা ভ্রমণ করেছেন। বাংলার নদী গাছ ফসলের মাঠ দেখে তারা যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি জানার চেষ্টা করছেন সে সময়ের মানুষের জীবন-সংস্কৃতি। পরবর্তীতে তাদের কেউ কেউ ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেছেন। ছবি এঁকেছেন। লেখা ও ছবি থেকে বিস্মৃত প্রায় বাংলাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
ইতিহাস বলছে, মধ্যযুগে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে তো বটেই, ইউরোপ আফ্রিকা থেকেও পর্যটকরা বাংলায় এসেছেন। না, আজকের মতো এত ভাল রাস্তা বা যানবাহন তখন ছিল না। নদীপথ ছিল মূল ভরসা। লম্বা সময় নৌ ভ্রমণের পর নোঙর করত পর্যটকদের তরী। স্থলপথে কখনও ঘোড়ায় চড়ে, কখনওবা হেঁটে এগিয়ে গেছেন শুধু। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ালেও, বিদেশীদের আগ্রহের মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকা। বিশেষ করে মোগল শাসনামলে শহরের গুরুত্ব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এ সময় সুবে বাংলার রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে শহরের নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে যারা বাংলা ভ্রমণ করেছিলেন তাদের অন্যতম রোমান পর্যটক গ্রিনি। দ্বিতীয় শতকে এসেছিলেন আলেকজান্ড্রিয়ার টলেমি।
পঞ্চম শতকে বাংলায় আসেন চৈনিক তীর্থযাত্রী ফা-হিয়েন। মধ্য এশিয়া ভারত ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করে এ সংক্রান্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যান তিনি। সে অনুযায়ী, প্রথমে আসেন ভারতে। ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৬৪ বছর বয়সী ফা-হিয়েন ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। মধ্য এশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম ভারত ঘুরে তিনি উত্তর ভারতে এসে পৌঁছেন। যতদূর জানা যায়, বৌদ্ধ ধর্মের মঠতান্ত্রিক নীতি সংবলিত গ্রন্থ ‘বিনয় পিটক’-এর সন্ধানে ভারতে এসেছিলেন তিনি। এরপর একে একে গঙ্গা উপত্যকায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির পবিত্র স্থানগুলো দর্শন করেন। ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে তিনি সীমান্ত রাজ্য চম্পার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন বলে জানা যায়। এজন্য সঙ্গী সাথীসহ দীর্ঘ পথ পায়ে হাঁটেন। তিব্বতের পামীর মালভূমির দুর্গম পথও পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
আর হিউয়েন সাঙের নামটি তো অনেকে পাঠ্য বইয়ে পড়েছেন। এ নাম মোটামুটি সবার জানা। সপ্তম শতকে বাংলায় আসেন তিনি। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে চীন থেকে যাত্রা শুরু করেন। উত্তরের বাণিজ্য পথ ধরে মধ্য-এশিয়ার কুচ হয়ে উত্তর ভারতে পৌঁছান। কনৌজ নগরে পৌঁছে তিনি মহান ভারতীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের আতিথ্য লাভ করেন। তিনি মগধের বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থান পরিদর্শন করেন এবং অনেক সময় তৎকালীন বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র নালন্দা মহাবিহারে পড়াশোনায় অতিবাহিত করেন। সেখান থেকে তিনি প্রবেশ করেন বাংলায়। বাংলায় ভ্রমণকৃত বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ছিল প্রধানত কর্ণসুবর্ণের নিকটবর্তী রক্তমৃত্তিকা, পুন্ড্রনগর ও এর সংলগ্ন এলাকা, সমতট ও তাম্রলিপ্তি। তার বিবরণ অনুসরণ করে বাংলার বহু প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
বাংলা ভ্রমণে আসা আরেক বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। মরোক্কোর পর্যটক ১৩৪৬ সালে বাংলা ভ্রমণ করেন। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই তিনি পৌঁছেন সাদকাঁও, মানে চাটগাঁও বা চট্টগ্রাম। সেখান থেকে এক মাস পথ চলার পর কামারু বা কামরূপে পৌঁছেন। পরে নদীপথে ১৫ দিন ভ্রমণ করে এসে পৌঁছেন সোনারগাঁও শহরে। বাংলার প্রাণ প্রকৃতি তাকে দারুণ মুগ্ধ করেছিল। ভ্রমণ কাহিনীতে তিনি লিখেছেন, আমরা পনেরো দিন নদীর দুপাশে সবুজ গ্রাম ও ফলফলাদির বাগানের মধ্য দিয়ে নৌকায় পাল তুলে চলেছি, মনে হয়েছে যেন আমরা কোন পণ্যসমৃদ্ধ বাজারের মধ্য দিয়ে চলছি। নদীর দুই কূলে জমিতে জলসেচের পানি কল, সুদৃশ্য গ্রাম ও ফলের বাগান, যেমনটি রয়েছে মিসরের নীলনদের দুই তীরে।
ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে চারটি স্থান ও তিনটি নদীর রেখাচিত্র পাওয়া যায়।
এদিকে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসা চৈনিক পর্যটক মা হুয়ানও চট্টগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করে সোনারগাঁয়ে নোঙর করেন।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ইউরোপীয়দের মধ্যে ঢাকায় প্রথম আসে পর্তুগীজরা। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহর আমল (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) থেকে পর্তুগীজদের আসা শুরু হয়। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন বণিক-পর্যটক সেবাস্তিন মানরিক। তার মতে, ঢাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই বিদেশী বণিকদের আকৃষ্ট করেছিল। বাংলা থেকে বিদেশে রফতানি হওয়া পণ্যের একটি তালিকাও তার কাছ থেকে পাওয়া যায়, যেখানে রয়েছে ধান, চিনি ও তেলসহ কিছু পণ্য। ঢাকা ও শহরতলীর জনসংখ্যা তখন দুই লাখ ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ইংরেজ বণিকদের মধ্যে প্রথম এসেছিলেন জেমস হার্ট। দ্বিতীয়জন টমাস প্রাট।
বাংলায় ফরাসীদের আগমন ঘটে সপ্তদশ শতাব্দীর ৮-এর দশকে। ফরাসী চিকিৎসক পর্যটক ফ্যাসোয়াঁ বার্নিয়ে ও বণিক পর্যটক তাভারনিয়ে একইসঙ্গে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় প্রবেশ করেন। বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলে বার্নিয়ে। তার বর্ণনা অনেকটা এ রকম- দেশটিজুড়ে অসংখ্য নদীনালা। তার চতুর্দিকে শস্য ও ফলে পরিপূর্ণ সবুজ প্রান্তর।
১৬৬১-৭০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আগমন করেন ইতালিয়ান পর্যটক ইতিহাসবিদ নিকোলো মানুচি, ফরাসী পর্যটক ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ে এবং জাঁ ব্যাপটিস্টতাভারনিয়ে। মুনচি থেকে জানা যায়, ঢাকায় সে সময় দুটি বিদেশী কুঠি ছিল। একটি ইংরেজদের। অন্যটি ওলন্দাজদের।
এর বাইরে চিত্রশিল্পী চার্লস ডি’ওয়লি ও জর্জ চিনারির কথা বলতে হবে। কর্মসূত্রে ঢাকায় এসেছিলেন বটে ডি’ওয়লি। তবে চোখ ছিল পর্যটকের। ১৮০৮ থেকে ১৮১১ পর্যন্ত ঢাকার কালেক্টর ছিলেন তিনি। ওই সময় ঢাকা ঘুরে বেশ কিছু ড্রইং করেন তিনি। সেই সব ছবি আজ ইতিহাসের অমূল্য স্মারক হয়ে আছে। অপর জন জর্জ চিনারি ঢাকায় আসেন ১৮০২ সালে। তিন বছর ঢাকায় ছিলেন। তিনি প্রায় ৫০টির মতো ছবি এঁকেছিলেন। তার ছবিতেও বাংলার প্রতি ভালবাসা প্রকাশিত হয়।
সব মিলিয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল প্রাচীন বাংলা। আজ যখন বাঙালী হন্যে হয়ে বিদেশে ছুটছে, যখন ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধী হচ্ছে বহু যুবকের তখন ভাবতে অবাক লাগে, একসময় জীবিকার সন্ধানে ভ্রমণের নেশায় বিদেশীরা আসত আমাদেরই দেশে!