ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

অপচিকিৎসা ও প্রতারণার ফাঁদ

ভুয়া তান্ত্রিকদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১৯ জুলাই ২০২১

ভুয়া তান্ত্রিকদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে

চট্টগ্রাম অফিস/নিজস্ব সংবাদদাতা, বান্দরবান ॥ দেশের পাহাড়ি এলাকার ভুয়া তান্ত্রিকদের পক্ষ থেকে সর্বরোগের চিকিৎসা তথা অপচিকিৎসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বান্দরবান সিভিল সার্জন এ তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি ইতোমধ্যে অবহিত হয়েছে। সাধারণ কিছু মানুষকে ফাঁদে ফেলে অপচিকিৎসা ও প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে ভুয়া তান্ত্রিকদের একটি চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে এক ধরনের তান্ত্রিক ও কবিরাজের লিফলেটে ভরে গেছে দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন ভবনের দেয়াল। নজর কাড়া রঙিন লিফলেটে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছে। আর এসব পোস্টারে মানুষের সহানুভূতি পেতে ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বান্দরবানসহ অপর দুই পার্বত্য জেলার কবিরাজ বা বৈদ্য বলে পরিচয় দেয়া হলেও তারা পার্বত্য জেলার বাসিন্দা নন; মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য মূলত দেশের বিভিন্ন জেলার প্রতারকরা পার্বত্য জেলার তান্ত্রিক, কবিরাজ, বৈদ্য বলে প্রচার করে এই কাজটি করছে অবলীলায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এসব তান্ত্রিকের লিফলেট বা পোস্টারে কোনটায় গাছের শিকড়, কবুতর, সাপ, বেজি, গাছ, মানব কঙ্কালসহ নানা কিছুর ছবি থাকে। আবার কোনটায় থাকে নারী-পুরুষের ছবি। আর এসব লিফলেটে শোভা পায় ক্যান্সার চিকিৎসা, করোনা মুক্তি, স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে বন্ধন, নিঃসন্তান, জায়গাজমি নিয়ে ঝামেলা, পারিবারিক অশান্তি দূর করা, অসাধ্য সাধন, জিন-পরীর আসর থেকে রক্ষাসহ সব বিষয়ে সেবা ও আকর্ষণীয় বক্তব্য। আগে বিভিন্ন নামে সর্বরোগের এসব চিকিৎসক মানুষের বসতবাড়ি ও ভবনের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানোর কাজ করলে তারা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুস্টিংয়ের মাধ্যমে প্রচার, এমনকি জনপ্রিয় ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলায়, আবার কখনও ডিশ ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে এসব প্রচার হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জেলার হাটবাজারের পাশাপাশি তারা স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আশেপাশে সবচেয়ে বেশি লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করে থাকে। স্কুলে সন্তানদের আনা- নেয়ার সময় এসব অশ্লীল পোস্টার দেখে অনেক অভিভাবক লজ্জায় পড়েন, আর কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পড়ে যায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এই বিষয়ে বান্দরবান শহরের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পৌর এলাকায় এসব অপচিকিৎসার পোস্টার লাগানো হলেও এ বিষয়ে পৌরসভাসহ প্রশাসনের কোন পদক্ষেপ দেখা যায় না। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে তথ্য সম্প্রচার আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এভাবেই প্রচারিত হয় প্রতারণামূলক টিভি বিজ্ঞাপন। এদেশের দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল জি বাংলায় প্রতিদিন নিয়ম করে দেখানো হয় এসব অশ্লীল বিজ্ঞাপন। যা একদিকে দেশের সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে টিভি দেখা যেন এখন লজ্জার বিষয়। চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন দেশের অসংখ্য অসচেতন মানুষ। জি বাংলার মতোই সনি এইটের একটি বিজ্ঞাপনে গানের সুরে সুরে আল্লাহ বরকত লকেট নামের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধানের বার্তা দেয়া হয় দর্শকদের। আবার কখনও ভারতের কামরূপ কামাক্ষার তান্ত্রিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে সর্বরোগের সমাধানের বার্তা দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনে প্রচারিত একটি নম্বর (০১৭৮৩৪৯১৬৯৭) ব্যবহারকারী রাসেল সাধু বাবার খেদমতগার পরিচয় দিলেও তার আসল নাম জুয়েল খান। সে টাঙ্গাইল সৃষ্টি একাডেমির শিক্ষার্থী এবং টাঙ্গাইলের বাসিন্দা হলেও বান্দরবানের বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে এই অপরাধ করে যাচ্ছে। অঞ্জলি চাকমা (০১৮৯০১১৮১৫২) ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে নিজেকে বৈদ্য বলে পরিচয় দিয়ে পোস্টারে বান্দরবান শহরের বালাঘাটা এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করলেও তার প্রকৃত নাম অঞ্জলি রানী, বালাঘাটায় তার কোন হদিস পাওয়া না গেলেও শুধু মোবাইল নম্বরকে অবলম্বন করে করছে রমরমা বাণিজ্য। এই বিষয়ে বান্দরবান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই ধরনের অপচিকিৎসা কেউ করছে অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্রে আরও জানা গেছে, সাধারণ মানুষ বিশেষ করে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পাহাড়ী এলাকার মানুষদের তন্ত্রমন্ত্রের জন্য পারদর্শী ভেবে বিশ্বাস করে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রতারকরা পার্বত্য জেলার বাসিন্দা পরিচয়ে মগ বৈদ্য, তান্ত্রিক স¤্রাট, পাহাড়ের তান্ত্রিক গুরু, গুরুমাতাসহ বিভিন্ন পরিচয়ে সারাদেশে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করে সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে চিকিৎসা ও জাদু টোনার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এসব ফাঁদে পড়ছে দেশের অশিক্ষিত শ্রেণী থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ। এই ধরনের এক অপচিকিৎসক আফরোজা বেগম। এই কবিরাজের ঠিকানা দেয়া হয়েছে রাঙ্গামাটির শুভলং। তার পোস্টারে ০১৮৮১০২৪২৩৪ নম্বরটি ব্যবহার করলেও নম্বরটির মালিক মূলত শিপন কবিরাজ। সে রাঙ্গামাটি জেলার বাসিন্দা নয়। এই বিষয়ে বান্দরবানের সিভিল সার্জন অং সুই প্রু মার্মা বলেন, এসব অপচিকিৎসায় যারা জড়িত তাদের বের করতে আমরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর এই বিষয়ে দ্রুত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয়রা মনে করছে, দ্রুত এসব ভুয়া বৈদ্য, কবিরাজ, তান্ত্রিকের অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ মানুষ।
×