মোরসালিন মিজান ॥ আজি দখিন-দুয়ার খোলা-/এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো...। আসছে বসন্ত। আগামী ১ ফাল্গুন ঋতুরাজকে বরণ করে নেবে বাঙালী। সে অনুযায়ী, হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। দেখতে দেখতে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। বিবর্ণ গাছপালা সবুজ হয়ে উঠছে। ফুলে ফুলে ভরে উঠছে বাগান। মানুষের মনেও শিহরণ। বসন্তকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হচ্ছেন সবাই।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। এর আগের ঋতুটি শীত। প্রকৃতি এ সময় বেশ রুক্ষ থাকে। পাতা হারাতে থাকে বৃক্ষ। জলের অভাবে ভূমিভাগ শুকিয়ে যায়। ধুলো উড়তে থাকে বাতাসে। এ অবস্থায় নতুন প্রাণের সঞ্চার করতেই যেন বসন্ত আসে। বসন্তের আবহাওয়া থাকে নির্মল। নাতিশীতোষ্ণ। বায়ুপ্রবাহে এক ধরনের দূরন্তপনা লক্ষ্য করা যায়।
এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বসন্ত বাতাসে সই গো/ বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে ...। বইতে শুরু করেছে বসন্তের বাতাস। নতুন ঋতুর আগমনী টের পাওয়া যাচ্ছে। বার্তা পেয়ে রূপ লাবণ্যে জেগে উঠছে প্রকৃতি। গত কয়েকদিন ঢাকার রমনা পার্ক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চন্দ্রিমা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গাছের নিচে শুকনো পাতা জমে আছে। পা ফেলতেই মচ্মচ্ ধ্বনি। কিন্তু উপরের দিকে তাকাতেই বিস্ময়। শুকনো ডালে উঁকি দিচ্ছে নতুন পাতা। কঁচি পাতা দেখে সতেজ একটা অনুভূতি হয়। তবে বসন্তের মূল রং রূপ ধারণ করেছে নানা জাতের ফুল। এরই মাঝে দৃশ্যমান হয়েছে লাল পলাশ। রঙিন হয়ে ওঠেছে শিমুলের বন। গোলাপ গাঁদা চন্দ্রমল্লিকারা হাসতে শুরু করেছে। কবির ভাষায়: বসন্ত, দাও আনি,/ফুল জাগাবার বাণী- তোমার আশায় পাতায় পাতায় চলিতেছে কানাকানি...। পাখিরাও বসে নেই। বসন্তকে ডেকে চলেছে। আপন মনে গাইছে তারা। হয়ত কান পাতলে শোনা যাবে কোকিলের কুহুতান। প্রকৃতিপ্রেমীরাও নিজের অজান্তে গেয়ে ওঠছেন: আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায় ...।
অবশ্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফুলের জন্য অপেক্ষা করে থাকার পক্ষপাতি নন। তিনি বলেছেন, ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত ...। তার মতে, বসন্ত নিজের বৈশিষ্ট্যের কারণেই উজ্জ্বল। হ্যাঁ, বসন্তের অর্ঘ্য ফুল। কিন্তু যদি তা না ফোটে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। হৃদয়ের পুলকটুকুই প্রকৃত বসন্ত। ফাল্গুন যুগ যুগ ধরে বাঙালীর মনকে জাগিয়ে তুলেছে। ভালবাসার জন্য প্রস্তুত করেছে। কবিগুরু তাই স্বীকার করে নিয়ে বলেন : ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল...। ভাললাগা ভালবাসার সৌরভ ছড়ানো নয় শুধু, মিলনের লগ্ন নিয়ে আসে বসন্ত। এমন লগ্নে প্রিয়জনের কাছে দেহ-মন সঁপে দিতে যেন বাধা নেই কোন। ভীরু প্রাণে কেবলই বাজে: মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে ...।
বসন্তের আগমনে উচাটন হয়ে উঠে মন। পুরনো বেদনা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ভালবেসে এর পেছনে আবারও ছুটতে প্ররোচনা দেয়। পাখিরাও প্রণয়ী খোঁজে এ সময়। ঘর বাঁধে। মৌমাছিরা মধুর খোঁজে হন্যে হয়। এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ছোটে। অনন্য এ বসন্তের জন্য অপেক্ষা না করে উপায় কী?
প্রিয় ঋতু ঘিরে এবারও উৎসবে মাতবে বাঙালী। সারাদেশে নানা আয়োজনে উদ্যাপিত হবে পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন বাসন্তী রং শাড়ি, পাঞ্জাবি পরে খুব সকালে বাসা থেকে বের হবে তরুণ-তরুণীরা। এখন পোশাক পছন্দের পালা। শপিংমলগুলোতে বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবী। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, বুঝি শুরু হয়ে গেছে উৎসব! মেয়েরা এদিন খোঁপায় পেঁচিয়ে নেবে হলুদ গাঁদার ফুল। দল বেঁধে ঘুরে বেড়াবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলার বকুল তলা, ছবির হাটসহ রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি। সবই প্রস্তুত হচ্ছে।
প্রতিবছরের মতোই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হবে বসন্ত উৎসবের। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে একযোগে চার ভেন্যুতে বসন্ত উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। আয়োজক সূত্র জানায়, চারুকলার বকুলতলায় সকাল ৭টা থেকে উৎসব শুরু হবে। মাঝখানে সামান্য বিরতি দিয়ে চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। ধানম-ি রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে চলবে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। একই আয়োজন থাকবে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে (লাবাম্বার পাশে)। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে উৎসব। পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে বাফার মাঠেও অনুষ্ঠিত হবে বসন্ত উৎসব।
আয়োজকদের পক্ষে মানজার চৌধুরী সুইট জানান, বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানমালায় থাকছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বসন্ত কথন, ফুলের প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আদিবাসী পরিবেশনা, শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা, আবৃত্তি, সঙ্গীত, বসন্ত আড্ডা, বাউল সঙ্গীত এবং বসন্ত শোভাযাত্রা।
এদিকে, বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বসন্ত ও বইপ্রেম দুটোর মিলন ঘটবে এখানে। উপচে পড়া ভিড় হবে প্রাণের মেলায়। প্রিয়জন পরস্পরকে বই উপহার দেবেন। ফুল উপহার দেবেন। সব মিলিয়ে ফাল্গুনের প্রথম দিনটি অনন্য সুন্দর হয়ে ধরা দেবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, বাংলাদেশের ছয় ছয়টি বৈচিত্র্যপূর্ণ ঋতু। প্রতিটি নতুন ঋতু প্রকৃতিকে কিছু না কিছু দান করে। বসন্তের বেলায় এটি আরও বেশি সত্য। এ সময় আমরা বাইরে যেমন ফুলের সমারোহ দেখি, তেমনি মনে এক ধরনের ভাললাগা তৈরি হয়। নিজের প্রকৃতির প্রতি ঐতিহ্যের প্রতি টান থেকে এবারও বসন্ত উৎসব উদ্যাপিত হবে। তবে এ ধরনের আয়োজনে বাণিজ্য যেন না ঢুকতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেন তিনি।