স্টাফ রিপোর্টার ॥ আদালতের বর্তমান মামলাজট কমাতে ও প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের প্রবেশাধিকারের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সঠিক মামলা ব্যবস্থাপনা একান্ত প্রয়োজন বলে জানান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। স্বল্প খরচে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, বিকল্প পদ্ধতিতে স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ মীমাংসা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থায় নতুন মামলার অন্তর্ভূক্তি হ্রাস করা মামলা ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য উপাদান হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
বৃহস্পতিবার জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি, সুপ্রীমকোর্ট এবং জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন বাংলাদেশ কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত ‘ন্যাশনাল জাস্টিস অডিটের ফলাফল উপস্থাপন ’ শীর্ষক আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
সভার শুরুতেই আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্পাদিত ন্যাশনাল জাস্টিস অডিটের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। জাস্টিস অডিটের তথ্যমতে ৬৮ শতাংশ মানুষ আনুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাবেন বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হওয়া স্বত্ত্বেও, তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আগ্রহী। অর্থাৎ মাত্র ১৩ শতাংশ বিচারপ্রার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায় দ্বারস্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে আদালতে ৩৪ লক্ষ মামলার জট তৈরি হয়েছে। আরো বেশি বিচারপ্রার্থী প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার দ্বারস্থ হলে পরিস্থিতি আরও ভিন্ন হতে পারত।
জাস্টিস অডিটের ফলাফল উপস্খথাপনায় দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে মূখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে বিচারাধীন মামলার প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ শতাংশ, দায়রা আদালতে এই হার ১৬ শতাংশ এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এই প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে ২০২২ সালে মূখ্য বিচারিক হাকিমের আদালত, দায়রা আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগে পূর্বের বছরগুলো থেকে আগত মামলার পরিমান হবে যথাক্রমে ৭২ শতাংশ, ৮০ শতাংশ এবং ৯০ শতাংশ। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে মামলা ব্যবস্থাপনার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপস্থাপনায় উল্লেখ করা হয়।
বিচার ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল এবং জনমুখী করতে আন্ত:প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট, মানব সম্পদসহ অন্যান্য সম্পদ বন্টন নিয়েও আলোচনা করা হয়। উপস্থাপনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দকৃত ১০ হাজার কোটি টাকার ৭ শতাংশ আদালতগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়ছে। এক্ষেত্রে যথাযথ বাজেট বরাদ্দের জন্যও উপস্থাপনায় সুপারিশ করা হয়।
প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে বলেন, “বিচারক সংকট, অবকাঠামোর অপ্রতূলতাকে মামলাজটের অন্যতম কারণ মনে হলেও, শুধুমাত্র বিচারক বা অবকাঠামো বৃদ্ধির মাধ্যমে এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সঠিক মামলা ব্যবস্থাপনা যা নিশ্চিত করতে আমাদের দুটি ধাপে কাজ করতে হবে। প্রথমত: মামলা দায়েরের পূর্ববর্তীতে - প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায মামলা দায়েরের হার যাতে কম হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত: মামলা দায়ের পরবর্তীতে প্রতিটি পর্যায়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্পব্যয়ে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।”
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি ব্যবহার করে বিরোধ মীমাংসার প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থা নতুন মামলার অন্তর্ভূক্তি রোধে বিকল্পভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রচলিত আইনি বিধানাবলী আরো সুক্ষভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, আদালতের জটবদ্ধ পুরাতন মামলাসমুহ যাতে দ্রুততর সময়ে নিষ্পত্তি হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে বিচারপ্রার্থীগণ যেন স্বল্পব্যয়ে ও দ্রুততর সময়ে ন্যায়বিচার লাভ করেন।”
আপীল বিভাগের বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইমান আলী’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আলোচনাসভায় জাস্টিস অডিটের ফলাফল উপস্থাপনা করেন আন্তর্জাতিক পরামর্শক জনাব এরিক ক্যাডোরা। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রমিতা সেনগুপ্ত, হেড অব প্রোগ্রাম, রুল অব ল’, জিআইজেড বাংলাদেশ; মিস জুডিথ হারবার্টসন, হেড, ডিএফআইডি বাংলাদেশ এবং জনাব মাইকেল শুলথহাইস, চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্স, এ্যাম্বেসী অব দ্যা ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানী। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচরকগণ, জিআইজেড এর কর্মকর্তাগণ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ।