স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ আজ থেকে ১৩ বছর আগে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহীর বাগমারায় এক কৃষক হত্যার মধ্যে দিয়ে এলাকায় উত্থান ঘটে মৌলবাদী সংগঠন জেএমবির। তৎকালীন বিএনপি সরকারের এমপি মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ মদদে হত্যা আর নির্যাতনের বিভীষিকা শুরু করে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদশ জেএমবি নামের ওই মৌলবাদী সংগঠনের জঙ্গীরা। এরপর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে বাগমারা থেকে অনেকটাই বিতাড়িত হয় জেএমবি সদস্যরা। ১৩ বছরের ব্যবধানে এ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের রাঘব বোয়ালদের কেউ কেউ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে। কিছু কারাগারে বন্দি আবার অনেকে আত্মগোপনে থাকলেও এখনও নির্মূল হয়নি তাদের কার্যক্রম। এখনও সেই বাংলাভাইয়ের হাত ধরে উঠে আসা এ সংগঠনের সক্রিয় সদস্যরা এলাকায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের জেএমবিই এখন নব্য জেএমবিতে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে পুলিশ এদের নাগাল পেলেও অনেকে এখনও রয়েছে আত্মগোপনে। ২০০৭ সালের ৭ জুলাই ময়মনসিংহ থেকে আটক করা হয় সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে। পরে বাংলা ভাইসহ শায়খ আব্দুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি এবং জেএমবির দুই হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মী কারাগারে থাকার পরও গত এক দশকে তাদের তৎপরতা ছিল। কিন্তু সেই তৎপরতা ব্যাপক না থাকলেও দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকার পর রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলার পর আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি’র নাম। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হোলি আর্টিজানে যারা হামলা করেছে তারা জেএমবি’রই একটি নতুন অংশ। তারা তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘নব্য জেএমবি’ নামে সংগঠিত হয়েছে। এরপর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলার জন্যও নব্য জেএমবি’র সদস্যদের দায়ী করা হয়। এই নব্য জেএমবি’র সদস্যরা এখন আইএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ। পুলিশ এবং র্যাব এরই মধ্যে ঢাকার কল্যাণপুর, আজিমপুর, পল্লবী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং মৌলভীবাজারে এই নব্য জেএমবির আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে নব্য জেএমবি নেতা তামিম চৌধুরীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক ‘জঙ্গী’ নিহত হয়েছে। নব্য জেএমবির হাতে থাকা সব আগ্নেয়াস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি।
পুলিশ এ পর্যন্ত গুলশান হামলায় ব্যবহৃত তিনটি একে-২২ রাইফেল এবং ১০টি পিস্তল উদ্ধার করেছে। এখনও বাইরে আরও একই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। আর নব্য জেএমবির সরাসরি রিক্রুট করা ৩০০ সদস্য আছে বলেও নানাভাবে জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে দেশে প্রধানত এখন দু’টি জঙ্গী গ্রুপ, একটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, যারা ব্লগার ও প্রকাশকসহ মুক্তমনাদের ওপর হামলা এবং হত্যায় জড়িত, আরেকটি নব্য জেএমবি, যারা গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার সঙ্গে জড়িত। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে মূল জেএমবি কিছুদিন কোণঠাসা হলেও থেমে থাকেনি তাদের কার্যক্রম। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলাতেই একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে সেই সময় আবারও আলোচনায় আসে জেএমবি। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে সেই জেএমবিই এখন নব্য জেএমবি। এখনও আঁতকে এদিকে ১৩ বছর পরেও বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠা জেএমবির নির্যাতনের সেই দৃশ্য এখনও ভুলতে পারেনি রাজশাহীর বাগমারার অনেক স্বজনহারা পরিবার। এখনও ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে আঁতকে উঠেন গোলাম রাব্বানী মুকুলের বৃদ্ধা মা খুদেজা বেওয়া। তার কানে এখনও বাজে সরাসরি মাইকে প্রচার করা ছেলের আর্তনাদের শব্দ।
ছেলে হয়তো ফিরে আসবেন এ আশায় এখনও বাড়ির বাইরে এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন তালেবের মা রাবেয়া বেওয়া। যেভাবে কষ্ট দিয়ে আমার ছেলেকে মেরেছে সেভাবেই জঙ্গীদের বিচার চান ইয়াছিনের মা আবেদা বিবি। ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখতে এখনও আদালতে বারান্দায় ধরনা দেন বাবুর বৃদ্ধ পিতা মহাসিন আলী।
১৩ বছরেও অগ্রগতি নেই ২২ মামলার
গত ১৩ বছরেও অগ্রগতি হয়নি নিষিদ্ধ ঘোষিত মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবির নৃশংস হত্যাকা-ের ২২ মামলা। অনেক মামলার নথিতেও জমেছে ধুলা। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার পলাশী গ্রামে চরমপন্থী সন্দেহে বাবু নামের এক যুবককে জবাই করে হত্যার মধ্যদিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবির।
এরপর ৪ এপ্রিল বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি সাজুড়িয়া গ্রামের আবু তালেবের। ৮ এপ্রিল পোল্ট্রি খামার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাহেরপুর স্কুল মাঠে জঙ্গীদের ডাকা ইসলামী সমাবেশে উল্টো করে টাঙ্গিয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী গোলাম রাব্বানী মুকুলকে।
নিজের বাড়ির সামনে নির্যাতনের আর্তনাদ সরাসরি মাইকে প্রচার করা হয়। ৩০ জুন বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে শিকদারী বাজারে শত শত মানুষের সামনে জঙ্গীরা কুপিয়ে কুপিয়ে প্রকাশ্য হত্যা করে সাকুয়া গ্রামের ইউপি যুবলীগ নেতা ইয়াছিন আলীকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে দুই মাসের ব্যবধানে বাগমারা, আত্রাই ও রানীনগর উপজেলায় ২২ জনকে হত্যা করে জেএমবির জঙ্গীরা। ১৩টি টর্চার সেল তৈরি করে নির্যাতন করা হয় শত শত মানুষকে। তাদের চাঁদাবাজির শিকার হন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু এসব ঘটনায় সে সময় কোন মামলা না হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা হয় ২২টি হত্যাসহ শতাধিক নির্যাতন মামলা। এরমধ্যে ২০০৮ সালে জেএমবির নির্যাতনের শিকার বাগমারার হাসানপুর গ্রামের ফজলুর রহমানের নির্যাতন মামলার রায়ে সাবেক দুই মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ ২৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।