ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শোলাকিয়ায় অংশ নেয়া ৩ জঙ্গী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে

আস্তানা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করার পথে দলে দলে জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৪ নভেম্বর ২০১৬

আস্তানা ছেড়ে আত্মসমর্পণ করার পথে দলে দলে জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গী গোষ্ঠীর নিরাপদ ঘাঁটিগুলোর পতন ঘটতে শুরু করেছে। বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠেছে জঙ্গী গোষ্ঠীর। এতদিনের নিরাপদ আস্তানা ছেড়ে দলে দলে জঙ্গীরা আত্মসমর্পণ করার পথ বেছে নিচ্ছে। আরও অনেক জঙ্গী সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রস্তাব দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষকে। বুধবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ঘোষণা দিয়ে রংপুরে জেএমবির ৩ জঙ্গী আত্মসমর্পণ করেছে। এর আগে গত অক্টোবর মাসে বগুড়ায় দুই জঙ্গী আত্মসর্মপণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আহ্বান ও কঠোর অভিযানের ফলে জঙ্গীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য তাদের পরিবারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। জঙ্গী বিষয়ক তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও র‌্যাব সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের ফলে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে জঙ্গীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে সঠিক পথে ফিরে আসার অঙ্গীকার করে আত্মসমর্পণ করছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নেয়া হচ্ছে। বুধবার রংপুর সেনানিবাসের চেকপোস্ট এলাকার শীতল অডিটোরিয়াম সেন্টারে আয়োজিত জঙ্গীবাদ বিরোধী এক সুধী সমাবেশের প্রধান অতিথি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করেন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার লোহারবান গ্রামের মন্দেল হোসেনের ছেলে হাফেজ মোঃ মাসুদ রানা, একই উপজেলার বিন্যাগাড়ি গ্রামের জিল্লুর রহমানের ছেলে হাফিজুর রহমান ও জয়রামপুর গ্রামের সারওয়ার হোসেনের ছেলে আখতারুজ্জামান ওরফে আক্তারুল। এর আগে গত অক্টোবর মাসে গুলশান হামলায় নিহত জঙ্গী খায়রুলের দুই সহযোগী জঙ্গীবাদ ছেড়ে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তারা হলেন বগুড়ার আব্দুল হাকিম ও গাইবান্ধার মাহমুদুল হাসান বিজয়। এই দুজনই উত্তরাঞ্চলের জেএমবির সদস্য। গত ৫ অক্টোবর র‌্যাব-১২র আয়োজনে বগুড়া শহরের শহীদ স্মৃতি মিলনায়তনে জঙ্গী বিরোধী সমাবেশ ও জঙ্গীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তারা আত্মসমর্পণ করে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকার চেক তুলে দেন। এ সময় আত্মমর্পণকারী দু’জনই নিজেদের ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, তারা ভালো হওয়ার সুযোগ নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। এর আগে যশোরে তিন দফায় হিযবুত তাহরীরের সাত সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। তারা হলো যশোর শহরের পুরনো কসবা কদমতলার আবদুল আজিজের ছেলে তানজিব ওরফে আশরাফুল, তার ভাই তানজির আহমেদ ও বোন মাছুমা আক্তার। তারা তিনজনই হিজবুত তাহরিরের সক্রিয় সদস্য ছিল। এর আগে গত ২১ আগস্ট ফখরুল আলম তুষার নামে যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ফখরুল আলম তুষার নামে হিযবুত তাহরীরের এক সদস্য আত্মসমর্পণ করে। এছাড়া গত ১১ আগস্ট যশোর শহরতলীর খোলাডাঙ্গা কদমতলা এলাকার মৃত শফিয়ার রহমানের ছেলে সাদ্দাম ইয়াসির সজল, শহরতলীর ধর্মতলা মোড় এলাকার আবদুস সালামের ছেলে রায়হান আহমেদ ও কদমতলা এলাকার এ কে এম শারাফত মিয়ার ছেলে মেহেদী হাসান পলাশ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা তিনজনও হিযবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য ছিল। গোয়েন্দা-তথ্য বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে নিরাপদ জোন হিসেবে ভাবছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের জঙ্গীরা। আত্মগোপনে থেকে ওই সব অঞ্চলের জেলাগুলোতে তারা ঘাঁটি তৈরি করেছে। গাইবান্ধা, রংপুর, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ পূর্ব দিকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে জঙ্গীরা যথেষ্ট তৎপর। ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনও সম্পন্ন করেছে তারা। কেবল উত্তরাঞ্চলেই ৬০ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গী আত্মগোপনে রয়েছে। এরাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় আস্তানা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। উত্তরাঞ্চলের লোকজন তুলনামূলক সহজ-সরল, দরিদ্র ও ধর্মভীরু হওয়ায় জঙ্গীরা এসব এলাকায় নাশকতা চালিয়ে আত্মগোপন করে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। এখানকার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা ঘিরে তাদের সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ নিচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে তৎপর হয়ে ওঠা জঙ্গী সংগঠনের শতাধিক আত্মঘাতী সদস্য পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়াতে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে আছে। পুলিশ ও র‌্যাবের তদন্ত সূত্র জানান, উত্তরাঞ্চলের বগুড়া জেলার একাধিক চরাঞ্চলে জঙ্গীরা আস্তানা গেড়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার সঙ্গে জড়িত একাধিক জঙ্গীর বাড়িও বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চল জেলার বিভিন্ন এলাকায়। মাদ্রাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত তরুণরা জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার কঠোর নজরদারি ও অভিযানের কারণে জঙ্গীরা তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এমনকি সামাজিকভাবে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি হয়। এ কারণে অনেক তরুণ জঙ্গীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গুটিকয়েক ব্যক্তি সহজ-সরল তরুণদের ইসলাম ও কোরানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। অনেকেই এসব ভুল ব্যাখায় মোটিভেটেড হয়ে ভুল পথে পা বাড়ায়। পরবর্তী সময়ে যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারে, তখন আর তাদের কিছু করার উপায় থাকে না। যারা জঙ্গী সংগঠন থেকে পালিয়ে বা ছেড়ে আসতে পারে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্যই আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার জঙ্গীরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, কথিত বড় ভাইদের মাধ্যমে কোরানের ভুল ব্যাখ্যার কারণে তারা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আহ্বানে যারা সাড়া দিচ্ছে তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। তাদের কোন মামলায় হয়রানি বা গ্রেফতার করা হবে না। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের আইনী সহায়তা করা হবে। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, জঙ্গীবাদ থেকে ফিরে আসাদের গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হবে।
×