
সৌদি আরবের উত্তরের হাইল প্রদেশে অবস্থিত দুটি অনন্য শিলাচিত্র এলাকা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে হাজার বছরের পুরোনো এক নীরব ইতিহাসের গল্প। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত ‘হাইল অঞ্চলের শিলাচিত্র’ (Rock Art in the Hail Region) প্রাচীন আরব সভ্যতার এক অসামান্য প্রতিফলন—যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানব সৃজনশীলতা এবং ইতিহাস এক বিন্দুতে মিলে গেছে। বিস্তীর্ণ মরু ও পাহাড়ঘেরা এই অঞ্চল শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক দিক থেকেও অতুলনীয়। এটি আজকের বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য ঐতিহ্যের জানালা খুলে দিয়েছে।
এই ঐতিহ্যবাহী শিলাচিত্র সম্পত্তিটি সৌদি আরবের হাইল অঞ্চলে দুটি পৃথক স্থানে বিস্তৃত—জাবাল উম্ সিনমান, যা হাইল শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে জুব্বাহ এলাকায় অবস্থিত, এবং জাবাল আল-মানজোর ও জাবাল রাআত, যা হাইল শহর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে শুআইমিস অঞ্চলে অবস্থিত। উভয় স্থানেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে নানা সময়কালের মানুষের খোদাই করা শিলাচিত্র ও লেখালেখির নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে, যা প্রাচীন আরব সভ্যতা, জীবনযাত্রা ও বিশ্বাসের এক অনন্য সাক্ষ্য বহন করে।
জাবাল উম্ সিনমান পাহাড়ের পাদদেশে একসময় একটি স্বচ্ছ জলের হ্রদ ছিল, যা বহু মানুষ ও প্রাণীর জীবিকা নির্বাহে সহায়ক ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রদটি শুকিয়ে গেলেও তার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিলার গায়ে খোদাই করা প্রত্নচিহ্ন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। এখানে পাওয়া পেট্রোগ্লিফ বা শিলাচিত্র ও প্রাচীন লিপি প্রমাণ করে, প্রাচীন আরব জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা এখানে বসবাস করতেন এবং তাঁদের জীবনচর্চার নিদর্শন এই শিলায় অঙ্কিত হয়ে আছে।
দক্ষিণ হাইলের শুআইমিস এলাকায় অবস্থিত জাবাল আল-মানজোর ও জাবাল রাআত নামের দুটি শৈলশিরা একসময় একটি প্রবাহমান উপত্যকার অংশ ছিল, যা বর্তমানে বালির স্তরে আবৃত হয়ে আছে। এখানকার পাথুরে গায়ে খোদাই করা হাজার হাজার মানব ও প্রাণীর প্রতিচ্ছবি প্রায় ১০ হাজার বছরের মানব ইতিহাস বহন করে। এই শিলাচিত্রগুলো কেবলমাত্র শিল্প নয়—এগুলো প্রাচীন মানব সমাজের পরিবেশগত পরিবর্তন, অস্তিত্বের সংগ্রাম ও সংস্কৃতির দলিল।
দুইটি স্থান মিলে সৌদি আরব তথা গোটা অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ শিলাচিত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। সহজ পাথরের হাতুড়ির মাধ্যমে খোদাই করা এই অসংখ্য চিত্র ও লেখনীগুলো কেবল চিত্রকলার নিদর্শনই নয়, বরং প্রাচীন মানব সমাজের পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে টিকে থাকার সংগ্রামের জীবন্ত স্বাক্ষর।
শুআইমিসের শিলাচিত্রগুলো হাজার বছরের পুরোনো এক বিলুপ্ত সমাজের নিঃশব্দ ইতিহাস তুলে ধরে, যাদের জীবনধারা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড আজ কেবল শিলার গায়ে খোদাই করা চিত্রেই টিকে আছে। এই চিত্রকলাগুলোতে পশু শিকার, মানব-মানবীর পারস্পরিক সম্পর্ক, অস্ত্রধারণ, ধর্মীয় আচার এবং যাযাবর জীবনের নানা দিক স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, যা প্রাচীন আরব অঞ্চলের সমাজব্যবস্থা, পরিবেশ এবং সময়ের পরিবর্তনকে গভীরভাবে অনুধাবনের সুযোগ করে দেয়।
হাইল অঞ্চলের এই দুটি এলাকা—জাবাল উম্ সিনমান ও জাবাল আল-মানজোর-রাআত—সরকারিভাবে চিহ্নিত, নথিভুক্ত ও সংরক্ষিত। সম্পত্তির প্রামাণিকতা প্রমাণিত হয়েছে প্রত্নচিহ্নের প্রাচুর্য, বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তা দ্বারা। সব নিদর্শন তাদের মূল অবস্থানে, প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে ও আদিরূপেই রয়েছে।
২০১৫ সালের ১৮ জুন সৌদি মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদিত নতুন প্রত্নতত্ত্ব, জাদুঘর ও নগর ঐতিহ্য আইন অনুযায়ী, এই স্থানগুলো আইনি সুরক্ষা পাচ্ছে। সৌদি পর্যটন ও জাতীয় ঐতিহ্য কমিশন (SCTH) এবং হাইল অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর কার্যালয় সরাসরি এগুলোর তত্ত্বাবধান করছে। যেকোনো অবৈধ হস্তক্ষেপ বা ক্ষতির তথ্য স্থানীয় পাহারা কর্মী, নাগরিক বা এমনকি বেদুঈন জনগণও জানাতে পারেন পুলিশের কাছে বা SCTH-এর মাধ্যমে।
এই দুই ঐতিহাসিক এলাকা বর্তমানে হাইল অঞ্চলের SCTH-এর আঞ্চলিক দপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, যা SCTH-এর রিয়াদ সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়। প্রতিটি সাইটেই রয়েছে প্রশিক্ষিত কর্মী ও নিরাপত্তা রক্ষী। বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্তির সময়ই একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যেখানে ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পর্যটন উন্নয়ন—দুই বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
২০০২ ও ২০০৪ সালের আঞ্চলিক পর্যটন পরিকল্পনার ভিত্তিতে পর্যটন ব্যাখ্যার একটি কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে এবং ভিজিটর ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়নের পরিকল্পনাও রয়েছে। তবে, পর্যটন বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় ভবিষ্যতে আরও কার্যকর মনিটরিং ও Heritage Impact Assessment পদ্ধতির প্রবর্তন অত্যন্ত জরুরি।
যদিও সম্পত্তির সংরক্ষণ অবস্থা বেশ ভালো, কিছু হুমকি রয়েছে—যেমন ভাঙচুর, বাফার জোনে অবকাঠামো নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া পর্যটন প্রসার। বিশেষ করে জাবাল উম্ সিনমান এলাকার দৃশ্যমানতার সুরক্ষায় পাশের একটি উঁচু পানির টাওয়ার ও ড্যাম অপসারণ বা দৃষ্টিনন্দনভাবে রুপান্তরের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, এই অঞ্চলের বাফার জোন আরও ১ থেকে ১.৫ কিলোমিটার পশ্চিম ও দক্ষিণে সম্প্রসারণের সুপারিশ রয়েছে।
হাইল অঞ্চলের এই শিলাচিত্রসমূহ কেবল সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এই নিদর্শনসমূহ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে, কিভাবে মানবজাতি হাজার বছর ধরে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং নিজের অস্তিত্বকে চিহ্নিত করে রেখেছে প্রকৃতির বুকে। তাই একে শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ নয়, বরং এটি মানব জাতির অমর কীর্তি হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
রিফাত