‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবায়’ এই সংগ্রামী স্লোগান রংপুর অঞ্চল থেকে
‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবায়’ এই সংগ্রামী স্লোগান রংপুর অঞ্চল থেকে যেনো বারবার জেগে ওঠে তীব্র আকারে সারাদেশে বারুদের মতো জ্বলে। এই বিদ্রোহী স্লোগান রংপুরকে গৌরবান্বিত করে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে শতবছর আগেই। রংপুরের তেজি সন্তানরা কেউ লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে, আবার কেউ স্বেচ্ছায় বুক পেতে দিয়ে স্বাধীনতার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছে বীর যোদ্ধাদের মতো।
‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবায়’ সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং প্রতিরোধের চেতনাকে ধারণ করে রংপুর অঞ্চলকে সংজ্ঞায়িত করেছে। অধিকারের জন্য দাঁড়ানো স্লোগানটি জনগণের শক্তি, ঐক্য, ন্যায় এবং সাম্যের জন্য তাদের অব্যাহত লড়াইয়ের একটি শক্তিশালী অনুস্মারক।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নুরলদীন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম শহীদ শংকু মজুমদার, শহীদ জানারা ইমাম, নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া আরো অন্যান্য রংপুরের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা রংপুরবাসীর দৃঢ়তা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
যেমন করে জেগে উঠেছিল আজ থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে ইংরেজদের শোষণ এবং লুণ্ঠনের সহযোগী এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র দেবী সিংহের ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল মৃতপ্রায়। দেবী সিংহ ছিলেন ইংরেজ মনোনীত এই অঞ্চলের ইজারাদার।
তার অসহনীয় অত্যাচার ও অন্তহীন অবাধ লুণ্ঠনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল পরিণত হয়েছিলো শ্মশানে।
চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিলো অসহায় কৃষকদের হাহাকার আর গগনভেদী দীর্ঘশ্বাস।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসহায় হরিণও ঘুরে দাঁড়ায়, এই অঞ্চলের নিরীহ এবং নির্বিবাদী কৃষকরাও তেমনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো।
খনির ঘন অন্ধকার থেকে যেমন করে উঠে আসে উজ্জ্বল হীরকখ-, তেমনি সাধারণ কৃষকদের মধ্য থেকে উঠে আসেন এক অসামান্য মানুষ, একজন অমিতবিক্রমশালী সিংহহৃদয় পুরুষ নুরলদীন।
১৭৩০ সাল এ বছরই এই অনন্য মানুষটি দেবী সিংহকে করে তোলেন নেংটি ইঁদুরের মতো ভীত, অসহায়।
রংপুরের বুকে নুরুলদিন যে বিপ্লবের লাল আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে নির্বাপিত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। আর যাকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ, সেই দেবী সিংহকে রংপুর ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো জান হাতে নিয়ে। জনগণের চূড়ান্ত জয় হয়তো হয়নি সেদিন, কিন্তু এই সাময়িক জয়ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে সগৌরবে।
১৭৬৭ সালের ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন রংপুর, রাজশাহী, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও কুমিল্লা জেলায় বিদ্রোহীদের আক্রমণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহীদের তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ১৭৬৭ সালে ক্যাপ্টেন ডি. ম্যাকেঞ্জির অধীনে রংপুরে ইংরেজ বাহিনী প্রেরিত হয়। এ সময় মালদহের ইংরেজ রেসিডেন্ট বারওয়েল কর্তৃক মার্টলের নেতৃত্বে প্রেরিত একটি ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের নিকট পরাজিত হয় এবং সেনাপতি মার্টল নিহত হন।
ম্যাকেঞ্জির বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহীরা নেপালের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকা- সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে, যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
এছাড়া নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া রংপুরকে ইতিহাসের পাতায় ঠেলে দিয়েছে।
শিক্ষা ছাড়া নারীমুক্তি হতে পারে না, আর নারীমুক্তি ছাড়া কখনও একটি সভ্য সমাজ গড়ে উঠতে পারে না, এ নিগূঢ় সত্যটা অনুধাবন করেন তিনি।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালী সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক।
বেগম রোকেয়ার পূর্বে তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন সামাজিক অবস্থায় অন্য কোন ব্যক্তিত্ব নারীদের উন্মেষ নিয়ে বলিষ্ঠ ও সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। তাই বেগম রোকেয়াকে আমরা নারী জাগরণের অগ্রদূতরূপে গণ্য করি।
বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল মূলত দুই ধরনের। একদিকে ঘুমন্ত নারী সমাজকে জাগিয়ে তোলা, অন্যদিকে সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। তার এ সংগ্রাম কখনও পুরুষের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তনই ছিল তাঁর কাম্য।
তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ রংপুরের শঙ্কু সমজদার।
তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে মানুষের মনে স্বাধীনতার চেতনা ও আকাক্সক্ষা দৃঢ় হয়। শঙ্কু মজুমদারের জীবন ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।
’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর সারাদেশের মতো উদ্বেলিত হয়েছিলো রংপুরের মানুষ। ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেও ১ মার্চ তা স্থগিত হওয়ার প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুরে হরতাল পালিত হয়।
শহরের কাচারি বাজার থেকে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় । মিছিলে রংপুর কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শঙ্কু সমজদারও অংশ নেন। মিছিলটি জাহাজ কোম্পানির মোড় হয়ে স্টেশনের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশ গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন শঙ্কু সমজদার।
২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর পুনরায় কোটা সংস্কার আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও ক্রমে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশ ও অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন শুরু করেন।
১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করেছে।
পুলিশের কঠোর অবস্থানের মুখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই পিছু হটেন এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
কিন্তু তাদের মধ্যে আবু সাঈদ পুলিশের সামনে গিয়ে বুক চিতিয়ে পুলিশের দিকে দাঁড়িয়ে থাকেন। পুলিশ তার দিকে রাবার বুলেট ছুড়লে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। আহত হয়ে মাটিতে বসে পড়ার পর আন্দোলনকারীদের কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয় এবং সেখানেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
শহীদ আবু সাঈদের শরীরে একাধিক রাবার বুলেটের ক্ষত ছিল। শহীদ আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ি রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন, তা বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে থাকবে। আবু সাঈদ ছাত্র জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। আর সেটাই যুগে যুগে সাহস এবং প্রেরণা জোগাবে ভবিষ্যতের গণবিদ্রোহ এবং জন-আন্দোলনকে।
আবু সাঈদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে পুরো দেশবাসীর কান্নায় রংপুর অঞ্চলের মাটি আজ সিক্ত।
আবু সাঈদের বোন সুমির আহাজারীতে বাংলার আকাশ বাতাস ভারী হয়। আহাজারি করতে করতে বলতে থাকেন,
“হামার মাও-বাপের কত আশা, হামার ছেলি একটা চাকরি করবি। ভাইডে হামার মরি গেল। হামার মাও এখন কেঙ্গিরি বাঁচে,”
ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর ঘটনায় আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, “তার হাতোত কোনও অস্ত্র আছিল না। তার পাও দুডো ভাঙি দিলো না, হাত একটা ভাঙি দিল না। আমরা চিকিৎসা করি কথা বলি দুডো শান্তি পানু।”
“ভায়োক হামার এভাবে মারাডা ঠিক হয় নাই। এর বিচার চাই,”
অন্যদিকে, সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম।
আক্ষেপের সুরে বলেন, “হাসিনা মোর বেটাক মারি ফালালি।”
গৌরবের রংপুরে জন্ম নেওয়া নুরলদীন থেকে আবু সাঈদ পর্যন্ত এক একটি নাম ইস্পাতসম কাঠিন্য অগ্নিশিখার অমিত আহ্বান, আছে আমার দেশের মাটির গন্ধের সাথে মিশে থাকা মাতাল এক অনুভূতি, আছে কাল পূর্ণিমায় রক্তলোলুপ হায়েনার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য গগনবিদারী কণ্ঠে ডেকে ওঠা এক প্রতিধ্বনির আশ্বাস
‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবায়’