ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

আলালের ঘরের দুলাল

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ১ আগস্ট ২০২৪

আলালের ঘরের দুলাল

প্যারিচাঁদ মিত্র

উপন্যাস পড়েননি শিক্ষিত মহলে এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু দেড়শো বছর আগের কথা একটু ভাবুন তো। সে যুগে মানুষ ছন্দে অভ্যস্ত ছিল। উপন্যাস নিয়ে তখন এত আগ্রহ ছিল না। বাংলার মানুষকে উপন্যাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন প্যারিচাঁদ মিত্র। যার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী প্যারিচাঁদ মিত্রই প্রথম বাংলা ভাষায় উপন্যাস লিখেন। চল্লিশ বছর বয়সে ‘মাসিক’ পত্রিকায় কয়েক সংখ্যায় উপন্যাসটি লেখেন। ১৮৫৪-তে ‘মাসিক’-এ ছাপা হয়।

বলে রাখা ভালো, এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সে সময়কার প্রসিদ্ধ গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার। রাধানাথ শিকদার ও প্যারিচাঁদ মিত্র ছিলেন বাল্যবন্ধু। পত্রিকায় প্রকাশের বছর চারেক বাদে এটি বই আকারে ছাপা হয়। পুরো কলকাতাজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। প্যারিচাঁদ মিত্র এই নতুন সাহিত্যটিকে পরিচিত করান ‘উপন্যাস’ নামে।
 ‘আলালের ঘরের দুলাল’ সে সময় সাহিত্যিক মহলে আরেকটি কারণে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কারণটি ছিল, গুরুগম্ভীর সাধুর বদলে সমাজের সাধারণ জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত চলিত ভাষার প্রয়োগ। হালকা চালে এর ভাষার বিন্যাস করা হয়েছে।

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দিকে লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে শুধু ধর্মীয় বা রোমান্টিক আখ্যান-উপাখ্যান। তৎকালে কবিগণ ধর্মের আশ্রয়ে তাদের রচিত সাহিত্য প্রসিদ্ধ করেছেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের এ সাহিত্যটিতে প্যারিচাঁদ নিয়ে এলেন সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা, প্রথা, সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতির জিগির। সদ্য পরাধীন একটি দেশ। সে দেশের সংস্কৃতি, রীতি-নীতিতে অবাধে হচ্ছে দখলদারদের সংস্কৃতির মিশেল। কোর্ট-কাছারি, আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বাঙালি এগুলোকে আশ্রয় করে নতুন নতুন পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরছে, পাম্প শু ছেড়ে বুট ধরছে।

ঠিক এ রকম একটি সময়কে প্যারিচাঁদ বেছে নিয়েছিলেন। বাবুরাম বাবু। তার বিপুল বৈষয়িকতার মধ্যে তিনি ভুলে যান তার একমাত্র পুত্রকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে। পিতার এমন আদর ও ঔদাসীন্যে পুত্র মতিলাল বখে যায়। মতিলালই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করেই ঘটনা প্রবাহিত হতে থাকে। মতিলালকে বিভিন্ন উপায়ে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়ে বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাতেও মতি ফেরে না মতিলালের।

বাবার মৃত্যুর পর পুরো বিষয়-আশয় করায়ত্ত করে মতিলালের ভোগবিলাসতা ও অসৎকর্মের মাত্রা আর বেড়ে যায়। চারদিকে অসৎ ও কুসঙ্গ নিয়ে মতিলাল পরিবেষ্টিত থাকে সর্বদা। তার মা-বোন তাকে ত্যাগ করে। একপর্যায়ে মতিলালের কাশী গিয়ে মতি ফেরে। সেখানে মা ও বোনের সঙ্গে মিলন হয়।
তৎকালীন কলকাতার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপারে জানা যায় এর মাধ্যমে। 
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের কদর ও চাকরিতে অগ্রাধিকারের বিষয়ে যেন লেখকের ছিল কিঞ্চিৎ ক্ষোভ। আর দুর্নীতির বিষয়াদি তো উপন্যাসের একটি বড় আকর্ষণ। টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা সত্যে পরিণতকরণ দিয়ে যেন চিরপরিচিত সামাজিক সমস্যাগুলোই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন লেখক।
উপন্যাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করলেই সেসময়কার মানুষের স্বরূপের সন্ধান মেলে সহজেই। বাবুরাম বাবু, যিনি ছিলেন মতিলালের বাবা, দিবস-রজনী শুধু অর্থের পেছনেই ছুটেছেন। সন্তানকে অতি আদর ও বৈভবে রেখে নীতিহীন করেছেন। বাংলাদেশে এমন উঠতি ধনীরা খুব অপরিচিত নন। বাবুরাম বাবুর পুত্র মতিলাল। মাদকাসক্ত, চরিত্রহীন ও নীতিহীন এক কিশোর। 
বাবুরাম বাবুর শুভানুধ্যায়ী বেণীবাবু ও বেচারাম। যাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় মতিলালের শিক্ষার। শেষে তারা ব্যর্থ হয়। বাবুরামকে বেণীবাবু পুত্রের শাসনের ব্যাপারে উপদেশ দেয়। তবুও বাবুরাম বাবুকে নির্বিকার দেখায়। আর আছে বাবুরাম বাবুর চারপাশের মোসাহেবের দল। এরা হাঁ তে হাঁ, না তে না মেলায় সর্বাবস্থায়। ঠকচাচার সাহায্যে লেখক তুলে ধরেছেন উপনিবেশিক যুগের প্রারম্ভিক সেই জোচ্চোর শ্রেণিকে, যারা দুর্নীতিকে গ্রহণ করেছিল পেশা হিসেবে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কোনো জটিল উপন্যাস নয়। সরাসরি সুনীতি ও কুনীতির স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে এখানে। লেখক নিজেও মাঝে মাঝে উপদেশ প্রদান করেছেন। 
‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ৩০টি অধ্যায়ে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে শীর্ষে মূল ঘটনাগুলো কয়েকটি টিকা আকারে বলে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাগুলোকে তিরিশটি ভাগে ভাগ করে লেখা হয়েছে। দেখে মনে হবে, ছোট ছোট তিরিশটি গল্প। 
 উপন্যাসটিকে ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হয়েছে। এর ইংরেজি সংস্করণের নাম ‘দ্য স্পয়েন্ড চাইল্ড’। ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কে প্রথম উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া হলেও প্রথম সার্থক উপন্যাসের তকমাটি লেগেছে বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’-র গায়ে। 

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮

[email protected]

×