ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন

রোকেয়া ইসলাম

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ৩০ মে ২০২৪

একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন

একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আমার শহরে

রবীন্দ্রনাথ কি কখনও পিরোজপুরে এসেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে যে কেউ ‘না’ বলবেন। কিন্তু তবু তিনি এসেছিলেন। কবির কল্পনায়। কবিতার ভাষা হয়ে। কবিতার নাম ‘একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আমার শহরে’। কবির নাম শাহীন রেজা। পিরোজপুর তারই জন্মশহর। নিজের শহরে কল্পনায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসলেও জীবনানন্দ বাদে কবিতায় আঁকা অন্যান্য চরিত্রগুলো কিন্তু সবই পিরোজপুরের।

বরেণ্য কবি ও সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব পিরোজপুরেরই সন্তান। যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কবি ও অভিনয়শিল্পী শংকর সাঁওজাল, ক্ষমা দাসগুপ্তা, শাহানা আকতার আশির দশকে পিরোজপুরের সংস্কৃতি অঙ্গন কাঁপানো নাম। প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের বাবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজুদ্দিন, শহীদ বিধান আর শহীদ ভাগিরথী মহান মুক্তিযুদ্ধের এক একটি গৌরবজনক অধ্যায়। এই কবিতায় তাঁদের স্থান করে দিয়ে শাহীন রেজা শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখেননি, শহীদদের প্রতি তার শ্রদ্ধাকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কবিতা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন তা ছুঁয়ে যায় অন্যকে, কাব্যিক আচরণে স্পর্শ করে যায় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কবিতার নামে গ্রন্থের নামকরণ করে শাহীন রেজা এই কবিতাটিকে আরও উচ্চতায় স্থাপিত করেছেন। 
সমকালীন কবিতায় শাহীন রেজা একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। আশির দশকের যে ক’জন কবি এখনো মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি তাদের অন্যতম। আমি তাকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। তার কবিতার ভাষা আমার আত্মস্থ। দুটি লাইন পড়েই আমি বলে দিতে পারি এটা শাহীন রেজার কবিতা। আমার কবিতাজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এ কবির এই অলোচিত গ্রন্থটির অধিকাংশ কবিতাই আলোচনার দাবি রাখে।

এর প্রায় প্রতিটি কবিতার আঙ্গিকই নতুন। কবিতায় শাহীনের একটি বিরাট অর্জনই হচ্ছে তার শব্দপ্রয়োগ। প্রচ- গতিতে তিনি এগিয়ে যান। তার কবিতায় যতিচিহ্ন প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোও তার প্রমাণ।
গ্রন্থটিতে একটি লিমেরিকসহ বেশ কয়েকটি দ্বিপদী, চতুর্পদী কবিতা রয়েছে। শাহীন রেজা দীর্ঘ কবিতার চেয়ে মধ্যম কিংবা ছোট কবিতায় বেশি সাবলীল। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে সে কথা স্পষ্ট বোঝা যায়। সবকিছু ছাপিয়ে শাহীনের কবিতায় যে জিনিসটি মূর্ত হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে প্রেম।  

‘তোমাকে পড়িনি আমি 
অথচ রোজ দেখো দেয়ালের লেখা পড়ি
চোখ বুলাই প্রিয় পত্রিকায় 
বারান্দায় উঁকি দেওয়া পাখিটার চোখের ভাষা 
একান্তে করি পাঠ কি মুগ্ধতায়-’

এভাবেই ‘অনুতাপ’ আঁকতে আঁকতে কবি এক সময় চলে যান সেই উচ্চারণে-
‘তোমাকে পড়িনি আমি এ আমার পাপ
অদৃশ্য করাতে কাঁটে মৌনতার তাপ’।
এরপরই কবির সেই অমোঘ জিজ্ঞাসা-

‘নদীকে পড়তে হলে যে লেন্স লাগে 
নারীকে পড়ার জন্য তারও বেশি কি’?

কবিতার নাম অনুতাপ। একটি দীর্ঘশ্বাসে যার শুরু, অনন্ত জিজ্ঞাসায় তার শেষ।
শাহীন রেজা এমনই এক কবি। যার ক্যানভাস শুধু দীর্ঘতর নয় অর্থবহ, সাবলীল এবং হৃদয়গ্রাহ্যও। 
তার বন্ধু সৌমিত বসুকে নিয়ে ‘সৌমিতের জন্মদিনে’ কিংবা শঙ্খ ঘোষ স্মরণে ‘কবি যায়’ কবিতায় ব্যক্তি চিত্রণের পাশাপাশি যে কাব্য বিন্যাস, যে মূর্ততা দৃশ্যমান তা একজন ঋদ্ধ কবিকেই শনাক্ত করিয়ে দেয়। 
গ্রন্থটিতে মাকে নিয়ে লেখা ‘বাতিঘর’ কবিতাটি যেমন পাঠককে আপ্লুত করে তেমনি ‘আব্বা’ কবিতায় পিতার প্রতি কবির আস্থা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সিক্ত করে তোলে সবার হৃদয়। 
একজন কবি যখন নিজেকে নিজেই অতিক্রম করে এগিয়ে যান তখন তাকে আমরা বাহবা দেই, তার অগ্রসরমানতাকে স্যালুট জানাই। 
‘চারিদিকে কিছু আলো 
শুধু শুধু চমকালো
মেঘগুলো থাক দূরে 
সেই ভালো সেই ভালো’। 
‘সেই ভালো’ কবিতার এই চারটি লাইন একজন অসামান্য প্রতিভাধর কবির পরিচয়কেই প্রস্ফুটিত করে এবং তিনি শাহীন রেজা। যার কাব্য প্রতিভায় শুধু আশির দশকই নয় সমকালীন কবিতাজগতও বিস্মিত, মোহিত।
শিকড় থেকে প্রকাশিত এ গ্রন্থটিতে কবিতা রয়েছে ৩৪টি। তার মধ্যে ‘একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আমার শহরে’ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ‘ছায়াসুন্দর’, ‘জানালার পর্দায় বিসমিল্লাহ্ খান’, ‘অনুতাপ’, ‘কেউ কেউ ডাকে’, ‘মীরা’, ‘নক্ষত্র’, ‘তারাদের কথা বলো’ প্রভৃতি। চারু পিন্টুর অসম্ভব নান্দনিক প্রচ্ছদে শোভিত গ্রন্থটির মূল্য ২০০ টাকা। আমি শাহীন রেজার জন্মদিনে গ্রন্থটির বহুল প্রচারের পাশাপাশি কবির কবিতাময় দীর্ঘজীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

×