ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

ছোট কাগজ ॥ জগৎজোড়া সুরের আসন

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২২:২০, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪

ছোট কাগজ ॥ জগৎজোড়া সুরের আসন

সঙ্গীতের অনবদ্য ঝঙ্কারে তৈরি করা সুরের মূর্ছনায় আবৃত ‘সঙ্গীত মনন

সঙ্গীতের অনবদ্য ঝঙ্কারে তৈরি করা সুরের মূর্ছনায় আবৃত ‘সঙ্গীত মনন : জগৎজোড়া সুরের আসন’ সুখপাঠ্য সংকলনটি রাগ-রাগিণীর অথৈই সাগরে ডুব দেওয়া এক অনবদ্য নির্মাল্য। চিরন্তন এক সাঙ্গীতিক আধারই শুধু নন শৈল্পিক ঝঙ্কারে যাঁর নাম আজও অবিভক্ত ভারতের সম্রাটের মর্যাদায় অভিষিক্তও বটে। নতুন করে পরিচয়ের কোনো প্রয়োজনই পড়ে না- কিংবদন্তি এক সুর সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। যাঁর স্মরণে বরণে এই নিবেদিত আলেখ্য।

ইমতিয়াজ আহমেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত সংকলনটির কলেবর সাজানো হয়েছে দুই বাংলার স্বনামধন্য কথা ও সুর শিল্পীদের মনন এবং সৃজন দ্যোতনায়। ২০২৩ সালের দ্বিতীয় সংখ্যা নিয়েই আমার মতো সাধারণ মানুষের নিবেদন সমর্পণ। আরও এক আকর্ষণ পাঠকদের বিমুগ্ধ করবে কলেবরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানজুড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গানের ওপর বিশেষ আলোকপাত। উৎসর্গপত্রে যার নাম চিহ্নিত হয়েছে তিনি স্বনামখ্যাত এক স্মরণীয় শিল্পবোদ্ধা অসিত কুমার সাহা।

গ্রন্থের বিশিষ্টজনেরা যারা মূলত বইটি প্রকাশের ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা নিজেদের করে নিতে পেরেছেন। শুধু কি তারা প্রণম্য? তার চেয়েও বেশি সাংস্কৃতিক জগৎকে সমৃদ্ধ করার মহা আয়োজনের রথী-মহারথীর মর্যাদায়ও অভিনন্দিত। শুরুটা করা হয়েছে শফি আহমেদের ‘সুরে ও বাণীতে গাঁথা মুক্তিযুদ্ধের মাল্য’ আলেখ্য দিয়ে। বিস্তৃত বলার প্রয়োজনই পড়ে না। যেখানে শিরোনামই নির্ধারণ করে দেয় যথার্থ সারমর্ম।

এখানেই নজর কাড়বে অসংখ্য বাঙালি পাঠকের। যারা বিশ্বের বিভিন্ন সীমানায় নিজেদের আবাস গড়েছেন। পরবর্তীতে আছে অবিস্মরণীয় এক সাধনযজ্ঞ যাকে বলা হচ্ছে প্রণম্য। পরিচ্ছেদের নামই জানিয়ে দিচ্ছে সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের বন্দনায় অভিষিক্ত পুরো কলেবর শুরু করা হয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের ‘আমার কথা’ প্রবন্ধের শুভ সূচনায়। স্মরণ চেতনায় ঝঙ্কৃত হয়ে উঠল আলাউদ্দিন খাঁয়ের এক অভাবনীয় বিনয় আর বিনম্রতা।

স্যার আইজাক নিউটনের মতো জীবন সায়াহ্নে এই বিরল সঙ্গীতবোদ্ধার আক্ষেপ আর বেদনা। বলেছিলেন সুর আর হয়ে উঠল কই? সবই তো আজও বেসুরো বোধে বেদনাহত হয়ে আছে। বিশ্বের স্বনামখ্যাত বহু প-িতের মতো এই সঙ্গীতাচার্যেরও শৈশব-কৈশোর ঝড়-ঝাপটার এক দুঃসাহসিক পালাক্রম। এ কথা সুবিদিত আমাদের বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বরপুত্র ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভেতরের সঙ্গীত অনুরণনের বিরাট ভা-ার নিয়ে জন্মস্থান ত্যাগ করলেন এক অদম্য নেশায়।

বহু কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত থিতু হতে পারলেন সে সময়ের অনন্য সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ উজির খাঁয়ের ¯েœহ ছায়ায়। আর বোধ করি পেছন ফিরে তাকাননি। রাগ-রাগিণী ও বাদ্যযন্ত্রের বহুবিধ সম্ভারের সমৃদ্ধ আঙিনায় নিজেকে পরিপূর্ণ করেন সুর সাধক বহু প-িতের ছায়াঘন প্রতিবেশে। কিশোর থেকে যৌবনপ্রাপ্ত  আলাউদ্দিন খাঁয়ের জীবন রথ এগিয়ে যাওয়া এক সফল গল্পগাঁথা নয়, নিরেট বাস্তবতার ধূলি মাখানো সমৃদ্ধ জীবন বোধের পালাক্রম।

বিশ্ব ভ্রমণ করা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার ঝুলি আর সঙ্গীতের অপার মাহাত্ম্যে যে আলোকিত ঝর্ণাধারা তা আজ অবধি সঙ্গীতের মঙ্গলালোক। কোনো শেষ পরিশেষ নেই এমন গুণী আর সাধক জনের বহু নির্মাল্যে ভরা জীবন গাঁথার। প্রসঙ্গক্রমে আসতে হয় আর এক মহা প-িত বাদ্য-বাজনার অন্যতম পথিকৃৎ রবিশঙ্করের জীবন ধারার অনন্য পথপরিক্রমায়।

সকলেরই জানা আলাউদ্দিন খাঁয়ের হাত ধরেই বেড়ে ওঠাই শুধু নয়, কন্যার জামাতা হিসেবে আরও নিকটতম অবস্থানে চলে আসা পণ্ডিত রবিশঙ্কর সঙ্গীত গগনের উজ্জ্বলতম এক তারা। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাবার কথা’। সহজেই অনুমেয় গুরু-শিষ্যের এক অনবদ্য সঙ্গীত ভুবনে অবাধ বিচরণের সমৃদ্ধ আলেখ্য। প-িতজি তাই করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে নিজেরই পড়া তার সমৃদ্ধ বই ‘রাগ-অনুরাগ’।

বাংলা ও বাঙালির আর এক মনন শিল্পী ও বোদ্ধা সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহসহ বহু জ্ঞানী-গুণীর আলেখ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থটি আলোচনা শেষ হওয়ারই নয়। ‘রবি কিরণ’ অধ্যায়ে বাংলা ও বাঙালির অনন্য সাঙ্গেতিক প্রবাদ পুরুষ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। কবি সঙ্গীতকে উপমহাদেশীয় বলয়ে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নিয়ে গেলেন বিশ্ব সভার অবাধ বিচরণে। আর বিদ্রোহী কবি নজরুল? রাগ-রাগিনীর অনন্য ঝংকারে তাঁর গানের ভা-ার আজও বিশেষায়িতই শুধু নয়Ñ ব্যতিক্রমী ধারার বাহকও।

তবে অতি অবশ্যই সচেতন পাঠককে বইটি পড়ার অনুরোধ ও আবেদন থাকল। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও শিল্প নির্দেশনায় সোমনাথ ঘোষের অপার কৃতিত্ব মনে রাখার মতো। ভারতের অক্ষর প্রকাশনী সংকলনটির প্রকাশনায় যে দায়বদ্ধতার পরিচয় দেয় তা পাঠকের জন্য উপভোগ্যই শুধু নয়, গৌরব আর অহঙ্কারের বিষয়টি উপেক্ষণীয় থাকে না।

বই পর্যালোচনা মানেই স্বল্প বাক্যে পুরো বইয়ের সারৎসার পাঠকের সমীপে হাজির করা। সবটা আমার ক্ষুদ্র লেখনীতে সম্ভবই হয়নি। সঙ্গত কারণে উদ্দীপ্ত ও আগ্রহী পাঠকের এটি পড়া আবশ্যকই শুধু নয় উচিতও বটে। পাঠকপ্রিয়তা ও সর্বাঙ্গীণ প্রচারের বহুল প্রত্যাশায় সংক্ষিপ্ত নিবেদনের ইতি টানা হলো।

×