
কিশোর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিতে প্রদীপ দত্ত
ডিসেম্বর আসলেই আমাদের চেতনার বন্ধ দরজায় করাঘাত হয়। খুলে যেতে চায় সব ক’টা জানালা। মনে পড়ে ‘সে এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জীবনে’- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকর্ম, সাহিত্য আর নন্দনতত্ত্বের সব শাখায় কাজ কিন্তু একেবারে কম হয়নি। খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই লিখেছেন তাঁদের বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিকথা। পরাজিত হানাদার বাহিনীর দুরাচারী সেনাপতি থেকে শুরু করে, লিখেছেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অফিসাররা, আর লিখেছেন রণাঙ্গনে দায়িত্বরত বিদেশী সাংবাদিকদের অনেকেই।
এসব লেখায় উঠে এসেছে তাদের উপলব্ধি আর নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি । কিন্তু এই গণযুদ্ধের আবেগকে বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে ইতিহাসের সেই পাঠ গ্রহণে, যা থেকে নিতান্ত সাধারণ মানুষ তাদের নিজস্ব শ্রেণিচেতনায় মৃত্যুকে তুচ্ছ করে এই দেশপ্রেমিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এমনই একটি বই ‘একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ বইটির লেখক রবিউল ইসলাম নিজেই সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক বইটির প্রকাশক ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা। প্রচ্ছদ- কাজী যুবায়ের মাহমুদ, এপ্রিল ২০২১-এ প্রকাশিত একশত সত্তর পৃষ্ঠার এই বইটির মুদ্রিত মূল্য তিনশত ষাট টাকা।
একজন কিশোর, মুক্তিযুদ্ধের সূচনার দিনগুলোতে এর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে কিভাবে ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন। তারপর রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে শত্রুর বাংকার কব্জা করে দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিলেন; নিজে হয়ে গেলেন এক গৌরবময় ইতিহাসের দ্রষ্টা ও ¯্রষ্টা। তার এক নির্মোহ বিবরণ উঠে এসেছে এই বইয়ে। অকপট আর অসাধারণ বর্ণনায় একজন প্রকৃত মুক্তিয়োদ্ধার জীবন নিংড়ানো গৌরবগাথা এর পাতায় পাতায় লেখা হয়েছে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার বিবরণ, গ্রামের সাধারণ চাষি-মজুর তথা শ্রমজীবী মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রায় উপেক্ষিত ।
এখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের চাষি আর খেটে খাওয়া মানুষের অংশগ্রহণকে প্রামাণ্য হিসাবে ধরে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে মহদীপুর সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সম্মুখ ও গেরিলাযুদ্ধে লেখক অংশ নিয়েছিলেন। মহানন্দার তীরে রেহাইচরের যুদ্ধে যেদিন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শত্রুর গুলিতে শাহাদাতবরণ করেছিলেন, সেদিন তাঁর সহযোদ্ধা হিসাবে তিনি এই বীর সন্তানের অসম সাহসী লড়াই আর শহীদী মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যার আনুপূর্বিক বর্ণনা এই বইয়ের একটি অমূল্য সম্পদ।
বইটিতে মোট সতেরোটি অধ্যায় আর প্রতিটি অধ্যায়ে ছোট ছোট শিরোনাম করে যুদ্ধদিনের একেকটি ঘটনা কিংবা তার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা আছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘রাজাকারদের শিকার এক নিরীহ আদিবাসী’ শিরোনামে এক মর্মস্পর্শী ঘটনার বিবরণ পাঠকের মনকে ভারাক্রান্ত করবে। লেখক ও তার বাড়ির রাখাল একদিন দেখতে পেলেন, তাদের এলাকার কয়েকজন রাজাকার একজন হাবাগোবা ধরনের আদিবাসী লোককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটি নির্বিকারভাবে নিজের কোচরে রাখা মুড়ি চিবোতে চিবোতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। রাজাকারদের সবার কাঁধে বন্দুক। জিজ্ঞেস করলে তারা বললো, ‘আমরা যারা রাজাকারে নাম লেখালচ্ছি তারঘে আইজকা মেলিটারিরা বন্ধুক দিল।
প্রত্যেক ইউনিয়নের রাজাকারঘে একটা কইরা মালাউন দিল শিকার করার গনে’। লোকটাকে তারা নিয়ে যেতে থাকে পূনর্ভবা আর মহানন্দার সংযোগস্থলের খেয়াঘাটের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে বন্দুকের দুটো গুলির শব্দ। লেখকের ভাষায় ‘ঘৃণায় কষ্টে শব্দের উৎসস্থান দেখতে ইচ্ছে করল না। শুধু মনে হতে লাগল কয়েকজন পশু একজন মানুষকে শিকার করল’।
বইয়ের শেষদিকে চারটি পরিশিষ্ট অংশে আছে রাজাকার আলবদর আলশামস বাহিনীর কর্মকান্ড, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বোয়ালিয়া ইউনিয়নে হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংসতার বিবরণ। বইটির শেষে কয়েকটি আলোকচিত্র, ম্যাপ, শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি। লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের শেষ যুদ্ধ ও গুলিবিদ্ধ হবার পূর্ব মুহূর্তে শত্রুর বাংকারে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্দেশনারত অবস্থার একটি পেন্সিল স্কেচ; যা এঁেকছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র অর্ণব দাস ধন্য। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ যাদের হৃদয়ে আজও দোলা দেয়, চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় সেইসব বয়সী মানুষ কিংবা এই প্রজন্মের তরুণ পাঠক, তাদের সবার কাছে নিশ্চয়ই বইটি সুখপাঠ্য হবে।