ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বই ॥ ব্যতিক্রম ধারার উপন্যাস

দীপক চৌধুরী

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ৩১ আগস্ট ২০২৩

বই ॥ ব্যতিক্রম ধারার উপন্যাস

ব্যতিক্রম ধারার উপন্যাস

সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনার সামগ্রিক পর্যালোচনা ছাপিয়ে অন্তর্গত প্রাণশক্তি খুঁজে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। নাম : করোনাকালের প্রেম। লেখক বরেন চক্রবর্তী। ওই সময়কালে দুনিয়া অসহায় হয়ে পড়েছিল। সেখানে চিকিৎসক পাওয়া বা চিকিৎসা সেবা পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। বেঁচে থাকার এক ধরনের চ্যালেঞ্জও আমাদের ভেতর বসবাস করছিল এবং সেই সংকটকাল নতুন করে জীবনকে ভাবতে শিখিয়েছিল। বর্তমান বিশ^ায়নের যুগে করোনার আগ্রাসনে যখন পৃথিবী হাবুডুবু খাচ্ছিল সেই সময়কার জীবন-সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে রচিত এ উপন্যাস। অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল জীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের বিবরণ পাই এতে।

সমস্যাসংকুল এ উপন্যাসটি যতটা মনস্তাত্ত্বিক একই সঙ্গে ততটাই বাস্তব। করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা বা অপারেশন জীবনকে কেড়ে নিতে পারেÑ এটির আশঙ্কা থাকার পরও কাহিনির মূল নায়িকা ডা. তনিমা একবারের জন্যও মৃত্যু নিয়ে ভাবেননি। ভাবেননি উপন্যাসের অন্য চিকিৎসকরাও। লেখক বরেন চক্রবর্তী পেশায় একজন চিকিৎসক হলেও সুকৌশলে জীবনের বহুমুখী লড়াইকে তুলে ধরেছেন তাঁর এ উপন্যাসে। বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এ লেখক চিরাচরিত প্রথার বাইরে নিজস্ব ভঙ্গিমায় সৃষ্টি করেছেন বিশেষ এক মনোজগৎ। উপন্যাসটির মূল কাহিনি গড়ে উঠেছে ডা. তনিমা নামের এক গাইনোকোলজিস্টকে ঘিরে। একই সঙ্গে পাওয়া যায় ডা. শোভন, ডা. শেলি আর ডা. তন্ময়কে। প্রত্যেকটি চরিত্রের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য দেখানো হয়েছে।

নিজের মুন্সিয়ানায় চরিত্রগুলোকে লেখক দারুণভাবে প্রাঞ্জল করে তুলেছেন। সমসাময়িক সাহিত্য অঙ্গনে বরেন চক্রবর্তী যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তা ‘করোনাকালের প্রেম’ উপন্যাস পাঠ করলে বোঝা যায়। মৃত্যুচিন্তার মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে মানুষ যেখানে জীবনের পরিণতি নিয়ে আতঙ্কিত সেখানে এই প্রেমময় উপন্যাস এক নতুন আকর্ষণ এনে দেয় হৃদয়ের দোলাচলে। সময় ও স্মৃতি আর করোনাকালের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাই এ উপন্যাসের প্রধান উপকরণ। রোমান্স ও ট্র্যাজেডির সমান্তরাল প্রকাশ রয়েছে রচনাটিতে। কখনো কখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, বিপন্ন মানুষের আর্তি, অসহায়ত্ব, জীবনমুখী সংগ্রাম, মৃত্যুর ভয়াবহতা মানুষকে কীভাবে উদভ্রান্ত করেছিল এই স্মৃতিগুলোর দেখা পাই। লেখকের বিশ্লেষণে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটি পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই লড়াই ছিল প্রতিটি মানুষের।

চিকিৎসা পেশায় কাছ থেকে দেখা জীবন কাহিনীর সেই দিনগুলোর সংগ্রাম লেখকের রচনায় ফুটে ওঠে। লড়াইয়ের নানাকাহিনী মুহূর্তের জন্যও আমাদের স্বস্তি দিতে পারেনি। এসব কাহিনী এতোটাই বেদনাদায়ক ছিল যা বিশ^বাসীর জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। কলকারখানায় তালা, বড়বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূল দরোজা বন্ধ থাকা, অর্ধেক বেতন বা সিকি বেতনে চাকরি করা, চাকরি চলে যাওয়া, সংসার থেকে প্রিয়জনের ছিটকে পড়া, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাওয়া, প্রিয়জনের দূরে থাকা আর চারদিকে হতাশা মানুষকে দগ্ধ করেছিল। লকডাউন শুধু রাস্তায়ই নয়, লকডাউন নেমে এসেছিল মধ্যবিত্তের, নিম্মবিত্তের রান্নাঘরেও। মানুষের স্বাভাবিক জীবনচর্চা যারপর নাই বিষিয়ে তুলেছিল করোনা।

নিজের সন্তানদের অসহায়ত্ব দেখে নারী-পুরুষ শব্দহীন কাঁদছিল খাদ্যের অভাবে। মাস্ক পরিধান বাধ্য করা হয়েছিল। ‘করোনাকালের প্রেম’ পাঠ করে লক্ষ্য করা যায়, এতো কষ্টের ভেতরও উপন্যাসের পরতে পরতে রোমান্টিকতার ছোঁয়া ছিল। লেখকের অনন্য বর্ণনায় ও করোনাকালের নিষ্ঠুরতায় কখনো ফিকে হয়ে যায়নি ওই চিকিৎসক তরুণীর প্রেম। ডা. তনিমা নামের এক অদম্য সাহসী গাইনোকোলজিস্টের যাপিত-জীবনের লড়াইগুলো নন্দিত শিল্পে উত্তরিত হয়েছে এ রচনায়। সকলশ্রেণির পাঠকের মনে রেখাপাত করবে এ উপন্যাস।

নতুন ধারার এ রচনা এক ভিন্ন জগৎ সৃষ্টি করবে পাঠকের মনে- এটা অনুমান করা যায়। চোখ বন্ধ করে বলা যায়, রচনার গুণেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে ধরে রাখবে ‘করোনাকালের প্রেম’। ৭০৭ পৃষ্ঠার এ বৃহৎ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে অবসর প্রকাশনা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাসুক হেলাল। উপন্যাসটির গ্রন্থস্বত্ব অধ্যাপক ডা. শিখা গাঙ্গুলি চন্দনার। এটি লেখকের করোনা ট্রিলজি গ্রন্থমালার দ্বিতীয় উপন্যাস।

×