
.
কাজী নজরুল ইসলাম ও তার সৃষ্টি আমাদের জাতীয় জীবনের এক অপরিহার্য অধ্যায়। এ অপরিহার্যতা তার সৃষ্টির মর্মার্থ ও গুরুত্বের কারণে। জাতীয় কবি বলে নয়, জনপ্রিয় কবি বলেও নয়। আবেদন ও উপযোগিতায় তার সৃষ্টি সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব বহন করে। দিন দিন তা আরও গভীর ও প্রসারিত হচ্ছে। তার সৃষ্টির মর্মমূলে যে মানবিকতার শেকড় প্রোথিত, তা চিরকালীন আবেদনে সমৃদ্ধ, মহিমান্বিত। তার কবিতা ও গানের সংগ্রামী চেতনা, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতার আবাহন, মানবিক মুক্তি ও অনুপ্রেরণার চিরকালীন উৎস। যেন তা আঁধারের বুকে আলোর অভিযান, কাল থেকে কালান্তরে হৃদয় মথিত বাণীর নিনাদ। অমিয় কোলাহল, ঐশ্বর্যের ভান্ডার।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবন সংগ্রামের মূর্তপ্রতীক। এ সংগ্রামের শুরু তার শৈশব থেকেই। নানাভাবে নানা টানাপোড়েন তার জীবন প্রবাহকে পরিচালিত হয়েছে। দুবেলা খাওয়ার জন্য তাকে কাজ করতে হয়েছে লেটো গানের দলে, কখনো না রুটির দোকানে। তবে সৃজনশীলতার বোধ ও প্রতিভার স্ফুরণে তিনি কখনো চুপ করে বসে থাকেননি। জীবন ও সংগ্রামকে অবিচ্ছদ্যভাবে বরণ করেছেন। বলা যায় এ অভিযাত্রায় তিনি সব সময় পীড়িত ও নিঃষ্পেষিত হয়েছেন। এ নিঃষ্পেষণ আরও প্রসারিত হয়েছে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক বোধের স্পষ্ট অবস্থানগত কারণে। তবুও সে অবস্থাকে তিনি স্বাভাবিকবাবেই মেনে নিয়েছিলেন। তারই প্রতিভাস যেন তার দারিদ্র্য কবিতা। যেখানে তিনি অকপটে বলেছেন-
‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে ক’রেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা।- দিয়েছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হল তরধার; ( সঞ্চিতা)
উপমহাদেশের বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার সহজাত বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । তিনি শত বাধার মধ্যেও পথ চলেছেন। ব্যক্তিগত লাভ, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিময় জীবনযাপনের চেষ্টা করেননি কখনো। তার পক্ষে তা করা সম্ভবও ছিল না। তিনি তো যুগস্রষ্টা। তাই যুগের গতানুগতিক হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দেননি। সৃষ্টিকর্মে যেমন রবীন্দ্রবলয় থেকে আলাদা অবয়বে স্বমহিমায় প্রকাশিত হয়েছেন। যা বিশ্বাস করতেন তা ছিল তার সত্য ও শুভবোধ থেকে উৎসারিত। এ উৎসারণেরর ধারা তার জীবন ও সাহিত্যকে প্লাবিত করেছে। তিনি সত্য ও ন্যায়ের ঝান্ডা তুলে ধরেন নির্ভীক বীরের স্পর্ধায়। তাই ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ উচ্চকিত হয়। তার কলম অগ্নিঝরা লেখায়, প্রতিবাদ ও মুক্তির সাহসী মন্ত্রে ঝংকৃত হয়। কালের বেদনা ও অন্তরালের মর্মার্থ, মানবিক অভীক্ষায় পরিণত হয় কালের কণ্ঠস্বরে। এ ধরনের নিরাপোসকামিতা, আদর্শ ও নীতিতে বিশ্বাস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বহমান ছিল।
নজরুল ইসলাম কবিতা, গান, প্রবন্ধে তিনি যেমন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তেমনি সক্রিয় থেকেছেন সাধারণ মানুষের মুক্তি, শোষণ বঞ্চনামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশ, সমাজের জন্য। সংগ্রাম ও সন্তরণে এ পথকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এ জন্য তাকে অনেক ত্যাগ, অনেক বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। বাজেয়াপ্ত হয়েছে তার সাতটি বই। বন্দি হিসাবে কাটাতে হয়েছে জেলজীবন। চরম আর্থিক দুর্গতি শেষ জীবনে আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। এতকিছুর পরেও তিনি নিজ অভিযাত্রা থেকে পিছপা হননি। অন্ধকারে হারিয়ে যাননি। জীবন, জগৎ, সংসার যতই বিমুখ হয়েছে ততই তিনি তার গভীরে প্রবেশ করেছেন। উষার দুয়ারে আঘাত হেনে চেষ্টা করেছেন রাঙা প্রভাত আনার। বিষয়গুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যে কাজী নজরুল ইসলামের সকল সৃষ্টির শেকড়ে ছিল মানুষ ও মানবিকতা। এ বোধ ও ব্যাপ্তি চিরকাল মানবিক অভিযাত্রার মর্মবাণী হিসেবে সরবে হোক আর নীরবে হোক ধ্বনিত হয় সব সময়।
একবিংশ শতকের আজকের দিনে নজরুল ইসলামের সৃষ্টির আবেদন আরও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠছে। স্বাধীনতা, শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজের জন্য মানুষের সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে শোষণের জাল বিস্তার লাভ করছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প গ্রাস করছে রাজনীতি, সামাজিকতা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও উন্মাদনার অপকৌশলের মাধ্যমে। জাতিতে - জাতিতে বিরোধ, যুদ্ধ মানব সমাজকে বারবার হুমকি ও ত্রাসের মধ্যে আটকে ফেলছে। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিশ্বের বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে নিয়ত চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। অন্যদিক অস্ত্র ও নিজ আধিপত্য বিস্তারে ধনী ও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ক্ষেত্রে এ চিত্র সচরাচর পরিদৃষ্ট হয়।
জাতীয় জীবনে একটি অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক, স্বপ্নময় স্বদেশ সকলের আরাধ্য। নানা রকম কূটকৌশল অপতৎপরতা সে প্রচেষ্টা ও অভিযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সামাজিক অস্থিরতা, অশান্তি বাড়ছে। মানবিক সংহতি ও সহমর্মিতার বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। এ রকম বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি ও সৃজনশীল নজরুল আমাদের নিকট জরুরি হয়ে পড়েন। দুই দিক থেকেই তার মানস কামনা ও দৃঢ়তা আমাদের জাতীয় জীবনে সঞ্জীবনের ধারাকে বেগবান করে তুলতে পারে। মানবিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ নজরুলের মানব প্রেম ও প্রত্যয় আনতে পারে জাগরণ। তাই এটা স্পষ্ট যে যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে কমবেশি এ ধরনের বিরুদ্ধ পরিবেশ পরিস্থিতিও থাকবে। থাকবে বেঁচে থাকার লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই, মানুষ হিসেবে মানবিকতা প্রতিষ্ঠার লড়াই। নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, প্রবন্ধসমূহ মানবমুক্তির এ উজ্জীবনে শক্তি যোগায়, সাহস দেয়। আশার উদ্দীপ্ত করে। অনুপ্রেরণায় জাগিয়ে রাখে অধিকারকামী সকল মানুষকে। ব্যথিত, বঞ্চিত প্রাণে শোনায় অভয়বাণী। সময়ের সঙ্গে যুগে যুগে তা চলমান। কাল থেকে কালান্তরের নিনাদবাণী হিসেবে ধ্বনিময় চিরাকাল। কান্ডারি কবিতায় প্রত্যয় ও সতর্কতার সঙ্গে তিনি তা উচ্চারণ করেছেন-
- তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান
ইহাদের পথে নিতে হবে সঙ্গে, দিতে হবে অধিকার।