ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো  অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ২২:৫২, ৩০ মার্চ ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

মনে হয়, আমি তার খুব অপরিচিত কেউ আমাকে যেন তিনি চেনেনই না

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পর্ব-১৭

মনে হয়, আমি তার খুব অপরিচিত কেউ আমাকে যেন তিনি চেনেনই না, এর আগে কোনোদিন দেখেননি আমাকে। আমি তাকে একটি একলিয়ার দিলাম, আজকে হাতে নিয়ে নিজে নিজেই সেটি খেতে পারছেন, যদিও পেস্ট্রিগুলো তার আঙ্গুলে লেগে গেল। সম্ভবত এই পেস্ট্রিগুলো খাওয়াটাই তার কাছে সবচেয়ে সহজ বলে মনে হয়। উনি একলিয়ার খেতে ভালোবাসেন। টেলিভিশনে ষাটের দশকের একটি গান হচ্ছে- ‘তারপর কাল তোমার শুভ পরিণয় হবে’ এই রকমের কিছু। 
আমার সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আমার মা সব সময়ই আমার জীবনের অংশ ছিলেন। একেবারেই জন্ম থেকে আজ অবধি। তিনি বাজে গন্ধ পাচ্ছেন, কিন্তু আমি তার গায়ের পোশাকটা বদলে দিতে পারছি না। আশেপাশে কোনো নার্সকে দেখছি না। আমি তার গায়ে একটু অডিকোলন ছিটিয়ে দিলাম। 

ডিসেম্বর, রবিবার ১
আমি তাকে দেখতে এসেছি। আজ তার হাতে একটি কেক দিলাম, কেকটা হাতে নিয়ে খাওয়ার জন্য হা-মুখের কাছে ধরতে গেলে মুখটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, হাতটা তার ডান দিক থেকে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকল। কেকটা হাত থেকে নিয়ে আমি তাকে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলাম। তার খালি হাত দিয়ে সে তার ঠোঁটগুলোকে উপরের দিকে ঠেলে তুলতে থাকে। আমার মনে হচ্ছে, কোনো বাচ্চাকে আমি এরকম করতে দেখেছিলাম। কিন্তু কোথায় সেটা মনে করতে পারছি না। তার এই আচরণ দেখে আমার একটি বাচ্চার কথা মনে পড়ল।

কিন্তু কোনো বাচ্চাটাকে এমন করতে দেখেছিলাম সেটা আমার মনে পড়ছে না। যখন আমি এসব কথা লিখি- আমি তাড়াহুড়ো করে যাই মনে আসে তাই লিখে ফেলি। এই ধরনের হিবিজিবি করে লেখা, যেন এমন- আমি খুব অপরাধবোধে ভুগি। কোনো প্রকারের সাবধানী শব্দ না খুঁজে যা মনে হয়, সেভাবেই আমি আমার এই ডায়েরিটা লিখছি। আজকে তিনি ফুলতোলা প্রিন্টের একটা পুরনো বাথরোব পরে আছেন, যার সমস্ত সুতোগুলো টেনে বের করা। এই মুহূর্তে আমার মাকে দেখে মনে হচ্ছে- তিনি কোনো জন্তুর চামড়া পরে আমার সামনে এসে দাঁড়িছেন।

তিনি ফ্রুটজেলিটা খেয়ে শেষ করেছেন কিন্তু আমি যদি এই খালি বাক্সটা তার বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে যাই, তিনি আর এটাকে ছুঁয়েও দেখবেন না, ফেলবেনও না। এখন তিনি যা করতে পারেন তা হলো যেকোনো জিনিস ছোঁ মেরে ধরা, কোনোকিছুকে খাবলে ধরে সেটাকে ছিঁড়ে ফেলা। 
আমার মায়ের রুমমেট চশমা পরা মহিলাটি কাঁদছিলেন। তার চোখ দুটো জলেপূর্ণ। বলছিলেন- ‘আমি মরতে চাই’। তার পাশে বসেছিল তার স্বামী, লালচে চোখ, লোকটা মৃদুস্বরে উত্তর দিল- ‘তুমি তো মরছো না কিন্তু আমাকে  মরতে বাধ্য করছো’। তিনি হয়ত ঠিক কথাই বলেছেন। অন্যরুমের একটি মহিলার কণ্ঠ থেকে কোঁ কোঁ করা এক প্রকারের শব্দ ভেসে আসছে। শুনে মনে হচ্ছে- খামারের উঠানের চারপাশে বিচরণ করা হাঁসের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকাডাকি করছে সে। ফিরে যাবার আগে আমি মাকে একটু জল খাওয়ালাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি যেসব করছো, তার ফল তুমি পাবে’। প্রতিবারই তার এই ধরনের কথাগুলো আমাকে মেরে ফেলে। 
হাইওয়ে ধরে বাড়ি ফিরতি পথে আমার আঙ্গুলে তার অডিকোলনের গন্ধ পাচ্ছি। হঠাৎ আমার মনে ভেসে ওঠে- ইভত্যুতেঁর এক মেলায় তার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা। এই রকমেরই একটি গন্ধ, ওটা কি তার ফেসপাউডারের গন্ধ ছিল? এখন আমি প্রায়দিনই তার মুখে একধরনের কালো ছোপ দেখতে পাচ্ছি। আমি যখন ছোট ছিলাম, তাকে দেখতে লাগত একটা সাদা ছায়া । আমার ষোল বছর পর্যন্ত তিনি আমাকে বলতেন সাদা পুতুল। এইসব স্মৃতির কথা আমি কিভাবে ভুলতে পারি? আমার আর তার মৃত্যুর মাঝখানে যা দাঁড়িয়ে আছে তা হলো- আমার পাগলাটে বিকারগ্রস্ত মা। 

রবিবার ৮ 
তিনি আমার মুখোমুখি বসেছেন, মুখটা সামান্য একটু ফাঁকা, চুলগুলো পেছনে বাঁধা। একটি ফুলতোলা প্রিন্টের গাউন পরেছেন। আর এখন তার গা থেকে সেই দুর্গন্ধটা ভেসে আসছে কিন্তু আমি তার পোশাক পরিবর্তন করতে পারব না। আর অফিসে বসে গল্প করছে যে নার্স আর প্যারামেডিকরা, ওদের বিরক্ত করার সাহস আমার নেই। রুমে বসেই ওদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। তাদের মধ্যে একজন বলছে, ‘এসব করেও কোনো লাভ নেই’ ।

‘এত কিছু করছি কিন্তু কিছুই লাভ হবে না’ ( আমার মনে হয় সে টাকা জমাচ্ছে কিন্তু যথেষ্ট নয়)। মার হাতে একটি কেক দিলাম, কেকটা মুখে তুলে খেতে আজকেও তার সমস্যা হলো, ওটা খাওয়া হলে দ্বিতীয় আরেকটা দিলে তিনি নিজেই ওটা খেতে পারলেন। এই যে সামান্য উন্নতি দেখছি, এটা এখনো আশা জাগায়। আমার মায়ের মাথার একটি জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল, পরে আমি একজন নার্স ডেকে আনলাম, নার্সদের আড্ডায় সেই উদার দৃষ্টিভঙ্গির লম্বা চুলের পুরুষ নার্সটা, যে নিজেকে আদর্শবাদী বলে ডাকেন, আমার অনুরোধে তিনি এসে মায়ের মাথার ওই রক্ত বের হওয়ার ক্ষতটা দেখে গেলেন। 

রবিবার ১৫
তিনি ডাইনিংয়ে ছিলেন হুইলচেয়ারে বসা, দেয়ালের দিকে মুখ করে থাকা একমাত্র মহিলা। তিনি দেখছিলেন ছাদ থেকে জরিদার কাগজ দিয়ে সাজানো দেওয়ালটা। আমাকে দেখে ওই সাজসজ্জার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এটা আমার অ্যানির জামা’।  আমি সবসময়ই তার মনে আছি। এখনকার এই রুমের ওয়ালপেপারটি হঠাৎ করেই ১৯৫০ সালের ইভত্যুতেঁ  আমাদের ক্যাফেতে যে ধরনের সজ্জা ছিল তা মনে করিয়ে দিল। আমি উপলব্ধি করলাম, আমাদের শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত আসলে কিছুই পরিবর্তন হয়নি।

আর জীবনটা হচ্ছে গানের সঙ্গে মিলে থাকা দৃশ্যের পর দৃশ্যের একটি সিরিজ। আমার মা এবং আমি টেলিভিশন সেটের সামনে এসে বসলাম সবার সঙ্গে। আমার মায়ের পেছনে বসা এক বৃদ্ধা মহিলা আপন মনে কুটকুট করে হাসছিল। অন্যদিকে আরেকজন মহিলা তিনি সম্ভবত বিভ্রান্ত, তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এই তুমি হাসা বন্ধ করো, তোমাকে পাগলের মতো লাগছে’।  এই বলেই তিনি তার পাশে বসা এক কমবয়সী মহিলার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, যে মহিলা হুইলচেয়ারে বসা একজন প্রৌঢ়লোককে বিরক্ত করছিল।

তিনি সবাইকে মেজাজ দেখালেন, সতর্ক করছেন। জানালা দিয়ে আমি দেখলাম একটা লোক সারাক্ষণ এমন লোকদের ফোন করেই যাচ্ছে, যারা কখনো তার ফোনের প্রত্যুত্তর দেয়নি। তারপর আমি একজন মানুষের গভীর কণ্ঠস্বর শুনলাম, কিন্তু তিনি কে? দেখতে পেলাম না। মনে হলো কারো ভেতর থেকে একটি বন্য কণ্ঠস্বর উঠে আসছে। এখানে এইঘরে কণ্ঠস্বররা এখন তাদের আদিম অবস্থায় ফিরে এসেছে। একটি সান্তাক্লজের মূর্তি ঘরের দূরকোণ থেকে ফিরে তাকায়। টিভিতে জ্যাক মার্টিনের শো ‘কুইজ’ অনুষ্ঠানে কিছু লোক আমেরিকার ট্রিপ জিতেছে। যে মহিলা সবাইকে সতর্ক করছিলেন, তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ‘ওহ! দারুণ ব্যাপার’। (চলবে...)

×