ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ১৭:৫২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই

এ পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না যে স্মৃতির সাগরে ডুব দিতে পছন্দ করে না। হাসি আনন্দের যে স্মৃতি মানুষকে যখন তখন তাড়িত করে বেড়ায়। স্মৃতি রোমন্থন করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি নেয়া চেষ্টা করা হয়। তেমনি কিছু আবেগতাড়িত স্মৃতি কে উপজীব্য করে লেখক মো: আবু হাসান তালুকদার শামীম তা তুলে ধরেছেন তার শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধ বইটিতে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দেশ স্বাধীন করে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ফিরে এসেছিলেন কিংবা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় টা দেখেছেন সেই স্মৃতি আজও তাদের মনে জ্বলজ্বল করছে। লেখক তার শৈশবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ। শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধের যেসব ঘটনা এখনও তার মনে দাগ কাটছে সেসব নিয়েই লিখেছেন বইটি। শৈশবের স্মৃতি মধুর হয় কিন্তু লেখকের ছিল যুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি। জন্মস্থান টাঙ্গাইলের ভূক্তা গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব ঘটনা ঘটেছে তারই খন্ড স্মৃতি।

লেখার শুরুতেই লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যুদ্ধের শুরুর দিকে তার বাড়িতে কোন একটা বিষয় নিয়ে কানাঘুষা হচ্ছে, কিন্তু কি নিয়ে হচ্ছে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না। পরে জানা যায় নাটিয়পাড়া প্রতিরোধ যুদ্ধশেষে গভীর রাতে ২ জন বাঙ্গালি ইপিআর সেনা লেখকের বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং পরের কালীহাতি অপারেশনে এরমধ্য থেকে একজন নিহত হন। সেসব নিয়েই যে একধরনের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে তা লেখক ভালই আঁচ করতে পারছিলেন। রাত থেকে সকাল অব্দি আথিতিয়তা করার যে সুযোগ তার পরিবার পেয়েছিল তা তাদের পরিবারের প্রত্যেকেই স্মৃতিতে অমর হয়ে আছে। আজও সেই যোদ্ধাদের মন থেকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানান তার পরিবার।

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে যুদ্ধের ডামাডোল। লেখকের দাদা-চাচারা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে “ভি আকৃতির ট্রেন্স” তৈরি করছে। হানাদার সেনারা পাকা সড়ক ধরে যাওয়ার সময় মানুষের বাড়িঘর লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তো। মূলত শত্রুসেনাদের অতর্কিত আক্রমণের সময় লুকানোর জন্যই এই ট্রেন্স তৈরি করা হতো। লেখক তখন খুব ছোট, তাই অত কিছু না ভেবে ট্রেন্সের ভেতরে খেলা করতো। একদিন হানাদারেরা তাদের গ্রামে অতর্কিত আক্রমণ করে বসলে লেখক তার মা ও ছোটভাই ট্রেন্সে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে বাড়ির পিছনে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। কয়েকটা গুলি তাদের বাড়িতে পড়ে। মা ভয়ে দোয়া-কালাম পড়তে থাকে। হানাদারেরা গ্রামে প্রবেশ না করে ফিরে যায়। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় সবাই। সেদিনই শামীম প্রথম বারের মত “মাথার উপর কচ্ছপের পিঠের মতো টুপি” (হেলমেট) পড়া হানাদারদের দেখে।

এভাবেই যুদ্ধের নানা দিক পেরুতে থাকে এবং লেখকের ছোট্ট মনে স্মৃতি জমা হতে থাকে। প্রাণে বাঁচতে নিজ বাড়ি ছেড়ে মাঝে মধ্যেই ছুটতে হয়েছে এদিক সেদিক। যুদ্ধের ভয়াবহতা কেটে গেলে তারা আবার বাড়ি ফিরে আসে।  দেখতে পায় বাড়িতে একটি হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সেই পরিবারের বুড়ি’মার সাথে লেখকের নানা খুনসুটি এ অংশে তুলে ধরা হয়। তাদের বাড়িতে প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিতে থাকে। এদের দেখে লেখকদেরও মুক্তিযোদ্ধা হতে ইচ্ছে করতো। কলা গাছের খোল কেটে তারা হেলমেট বানাতো, মুক্তিযোদ্ধা সেজে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো। বুড়িমা তাদের বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় ভুলে একটি গয়নার পোটলা ফেলে যান। ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে তারা এটা খুঁজে পান। কিন্তু স্বযত্মে রেখে দেয়ায় বুড়িমার এক লোক ফিরে আসলে তার হাতে গয়নার থলেটি বুঝিয়ে দেয়া হয়। এতে সেই হিন্দু পরিবারটি বেশ অবাক হয় এবং তাদের জন্য দোয়া করতে থাকে।

যুদ্ধকালে এমন নানা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সঙ্গী হয়ে লেখকের দিনগুলো কেটে যায়। ১৬ ডিসেম্বমর আসে কাঙ্খিত বিজয়, দেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইলে আসলে লেখক তার দাদার সাথে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যায়। লেখককে দেখে, অনেক দূরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু হাত নেড়ে নেড়ে ভাষণ দিচ্ছে। লেখকের বাবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা সদস্য ছিলেন। পোস্টিং ছিল করাচীতে। শামীম জানতো তার বাবা মারা গেছেন। কিন্তু আদতে তা হয়নি, ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয় সে সময় লেখকের বাবা ফিরে আসছেন। লেখক দৌড়ে ছুটে যায়, জলপাই রঙের সোয়েটার পরিহিত লোকটি লেখককে জাপটে ধরে বলতে থাকে “আমার বাবা”। এভাবেই গল্পের ইতি টানেন তিনি।

চমৎকার স্মৃতিকথার একটি বই শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধ। যে কাউকে আবেগতাড়িত করবে বলে আশা করছি। এবারের(২০২৩) একুশের বই মেলায় দোয়েল প্রকাশনী থেকে  ৫৬ পৃষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এই স্মৃতি গ্রন্থটি দোয়েলের স্টল নং ১৬৬ ও ১৬৮ তে পাওয়া যাচ্ছে। মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ২০০ টাকা।

 

 

এমএস

×