ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

অনুবাদ সাহিত্য পুরস্কার

এই নগরীর সাহিত্যবাসর

কামরুল হাসান

প্রকাশিত: ০২:০২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

এই নগরীর সাহিত্যবাসর

বাংলাদেশ ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশনের পত্রিকা

বাংলাদেশ ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশনের পত্রিকা ‘যুক্তস্বর’-এর তৃতীয় সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন পর্বে মঞ্চে যোগ দিলেন আরও দুজন খ্যাতিমান অনুবাদক- অধ্যাপক আবদুস সেলিম ও আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া। মোড়ক উন্মোচন শেষে যার কথা বলা প্রাসঙ্গিক এ সংখ্যার সম্পাদক জ্যাকি কবির কথা বললেন। তিনি বললেন অনুবাদের কাজটি দুরূহ কিন্তু আনন্দের। ‘যুক্তস্বর’-এর এ সংখ্যাটি প্রথম দুটি সংখ্যার বিপরীত। এবার অনুবাদ হয়েছে বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তার কথা থেকে জানা গেল কিছু প্রত্যাশিত বাংলা গল্পের অনুবাদ পাননি, কিছু অনূদিত গল্পের মূল বাংলা ভার্সন পাওয়া যায়নি।
জ্যাকি কবিরের পর আমন্ত্রণ জানানো হলো এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সুদূর মেক্সিকো থেকে ছুটে আসা আলেহান্দ্রা রামিরেস অলভেরাকে। তিনি মেক্সিকো ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি। সভাপতি আসতে পারেননি, সহ-সভাপতিকে পাঠিয়েছেন। সভাপতি ও ফাউন্ডেশনের বোর্ডের সদস্যদের পক্ষ থেকে তিনি বাংলাদেশ ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু করলেন। আপাদমস্তক সাদা পোশাক পরিহিত এই মেক্সিকান অনুবাদক পাঁচটি ভাষা জানেন, তিনি যে বক্তৃতাটি দেবেন তা পাঁচবার সম্পাদনা করেছেন বলে নিজেই জানালেন। বক্তৃতাটি তার সন্মুখে রাখা ল্যাপটপে সংরক্ষিত থাকলেও তিনি সেটা থেকে তেমন পড়লেন না, বরং বেশিরভাগ বক্তব্য উপস্থিত বক্তৃতার মতো করে দিলেন।
‘আমরা কেন অনুবাদ করি’ এমন একটি মৌলিক প্রশ্ন দিয়ে তিনি শুরু করলেন। বললেন, আমাদের প্রত্যেকের একটি দেশ (যড়সব) আছে, এই ‘হোম’ হলো মাতৃভাষা (সড়ঃযবৎ ঃড়হমঁব)। এই ঃড়হমঁবটি শেষাবধি হয়ে দাঁড়ায় ঊহমষরংয। স্প্যানিশ ভাষার এই অনুবাদক যে সারা দুনিয়ায় ইংরেজির আধিপত্যে তেমন খুশি নন, তা বোঝা যায়। তার একটি বাক্য ছিল সংখ্যার (জনসংখ্যার বিচারে নয়, সেটা হবে চাইনিজ, দ্বিতীয় ইংরেজি) দিক থেক পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশে স্প্যানিশ ভাষা চালু। অন্যান্য ভাষার ভৌগোলিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক যড়সব-এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে অনুবাদ আমাদের সাহায্য করে। অনুবাদককে কেউ ধন্যবাদ দেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না, অথচ অনুবাদ একটি কঠিন কাজ, এ ছাড়া এক ভাষার সাহিত্য অন্য ভাষায় প্রবেশ করতে পারে না।


তাদের সংগঠনটি নবীন, ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। এর সদস্য সংখ্যা (তারা বলেন অ্যাসোসিয়েট) ১০০। মেক্সিকোতে ৪-৫টি অনুবাদ ফাউন্ডেশন রয়েছে। আর্জেন্টিনা, কলাম্বিয়াসহ পাঁচটি দেশের ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তাদের অষষরধহপব রয়েছে, পরস্পরের সাহিত্যের স্বাদ খুঁজে পেতে তারা চেষ্টা করছেন। তার কথা থেকে জানলাম তারা অনুবাদের ওপর ২ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করে এবং সনদ দেয়। সে নিজেও এই কোর্স করে সনদ নিয়েছে। ডিপ্লোমা কোর্স, সার্টিফিকেশন ইত্যাদি নিয়ে অতঃপর বক্তৃতাটি দীর্ঘ ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল এবং সে কারণেই হয়ে উঠল শ্রবণে ক্লান্তিকর। এর মাঝে আনন্দের সংবাদটি হলো মেক্সিকো ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন আনিসুজ্জামানকে অ্যাসোসিয়েট করে নিয়েছে। আনিসুজ্জামানের হাতে যে দ্বিধারি তলোয়ার তাতে এ স্বীকৃতি তার প্রাপ্য। আর একটি ভালো সংবাদ হলো বাংলাদেশ ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সলেশন (ঋওঞ)-এর সদস্য হতে পারে যদি তারা আবেদন করে। মেক্সিকো ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন সে আবেদনে রিকমেন্ডেশন দেবে। ভগ্নিপ্রতিম ভাষাগুলোর ভেতর পারস্পরিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন বলে খুবই স্বচ্ছন্দে ইংরেজি বলা স্প্যানিশ ভাষার এই অনুবাদক তার অহেতুক প্রলম্বিত বক্তৃতাটি শেষ করলেন।
এরপর পুরস্কার প্রদান। ২০২২ এ বাংলাদেশ ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশনের আজীবন সম্মাননা পেলেন বর্ষীয়ান লেখক অনুবাদক সালেহা চৌধুরী। শহীদুল জহিরের দুটি নভেলা ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ও ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’র ইংরেজি অনুবাদের জন্য যৌথভাবে বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পেলেন ভারতের ভি. রামাস্বামী ও বাংলাদেশের মেয়ে শাহারোজা নাহরিন।
সালেহা চৌধুরী মূলত একজন কথাসাহিত্যিক। লেখালেখির শুরু ষাটের দশকে। বড়দের জন্য যেমন লেখেন, তেমনি লেখেন ছোটদের জন্য। কথাসাহিত্যের পাশাপাশি তিনি প্রচুর অনুবাদ করেন। তার ৮০টি বইয়ের মাঝে ৩০টি বই অনুবাদের। স্বাধীনতার পরের বছর তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে বসবাস করলেও তার সময় এখন বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বিভাজিত। তার হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন বিটিএফের সভাপতি খালেকুজ্জামান ইলিয়াস, উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন শাহাব আহমেদ, ক্রেস্ট তুলে দিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আর পুরস্কারের অর্থমূল্য ১ লাখ টাকা তুলে দিলেন আনিসুজ্জামান। 
নিজের অনুভূতি জানাতে এসে সালেহা চৌধুরী বললেন, পুরস্কার পাবার মুগ্ধতা তিনি মন থেকে সরাতে পারছেন না। বললেন তিনি মৎধঃবভঁষ, যঁসনষবফ ধহফ ড়াবৎ ঃযব সড়ড়হ। শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ- আমি কৃতজ্ঞ, আমি বিনয়াবনত, আমি...। ঙাবৎ ঃযব গড়ড়হ-এর অর্থ বলতে গিয়ে চাঁদে আটকে গেলেন। এর যথাযথ বাংলা কী হবে জিজ্ঞেস করে তিনি মঞ্চে উপস্থিত দুই ডাকসাইটে অধ্যাপককে হতচকিত করে দিলেন কেননা তারা পরীক্ষা নেন, পরীক্ষা দেন না। সালেহা চৌধুরী, বয়সের কারণেই তাদের অগ্রজ। জিজ্ঞাসা তিনি করতেই পারেন। ক্ষণিকের বিব্রতাভাবটি কাটিয়ে খালেকুজ্জামান ইলিয়াস বললেন, ‘চাঁদে আছেন।’ নিভৃতে সৃষ্টিশীল সালেহা চৌধুরী আজ সত্যি চাঁদে আছেন।
    ছবি : লেখক

×