ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো, অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ০১:২২, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

আইয়ুব আল আমিন

(পূর্ব প্রকাশের পর)
শুক্রবার ১৯
আমার বেশ ভালোভাবেই মনে পড়ছে তার সেই সেমিজওয়ালা পেটিকোটটার কথা যেটা তিনি পরতেন, তার স্তনের নিচ থেকে নিতম্ব পর্যন্ত জড়িয়ে থাকত। আমি এটার সূক্ষ্ম কারুকাজের ভেতর দিয়ে তার চামড়ার ফাটলগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। 

বৃহস্পতিবার ২৫
আমি ‘দ্য কনফেসরস হ্যান্ডবুক’ বইটি পড়ছিলাম। এই পুরনো বইটি আমার প্রেমিক ‘এ’ আমাকে দিয়েছিল। পড়তে পড়তে ছোটবেলায় আমার মায়ের চোখের অভিব্যক্তিগুলো আমার মনে পড়ল, তিনিই ছিলেন সেই স্বীকারোক্তি গ্রহণকারী-কনফেসর। 
রবিবার ২৮
‘অকুলিট’- একটি শব্দ, যা তিনি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন আমাদের ক্যাফেতে আসা কিছু কাস্টমারকে লক্ষ্য করে, যারা সবসময় তাদের সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে মদ্যপান করতে আসত। তিনি মানুষকে এটা দেখাতে পছন্দ করতেন যে, তিনি কত জটিল জটিল শব্দ জানেন। এই মহিলা সবসময়ই এমন ভাব নিয়ে চলতে পছন্দ করতেন। 
মনে পড়ছে সেইসব দিনের স্মৃতিগুলো আমার বয়স ছিল ষোল- আশেপাশের ছেলেরা ক্রমাগত বন্যপ্রেমের আশায় আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত। কিন্ত তিনি আমার মা, আমার অভিভাবক, বলতেন- ‘তুমি অনেক ছোট, তোমার সামনে প্রচুর সময় পড়ে আছে। এখনই এসব নয়।’ কিন্তু একজনের হাতে কখনোই পর্যাপ্ত সময় থাকে না, এমনকি একজনের মা সম্পর্কে একটি বই লেখার সময়েও লেখার কাজটিকে কেন্দ্র করে অনিবার্যভাবে অনেক কিছুই সমস্যা হয়ে উন্মুক্ত হতে পারে, এমনকি সময়টুকু ফুরিয়ে যেতে পারে। 
সোমবার ২৯
তাকে আজ আরো বেশি শুকনো আর উ™£ান্ত লাগছে। তিনি যা পড়ে আছেন তা হলো হাসপাতালের গাউন, পেছনে খোলা, তার মেরুদ-, তার নিতম্ব আর প্যান্টির ভেতর দিয়ে তার ত্বক দেখতে পাচ্ছি। আমাদের উল্টোদিকের চকচকে জানালা দিয়ে একটি মহিমান্বিত সূর্য নেমে এসেছে। হঠাৎ করে কুঁড়ি বছর আগের ডরমেটরির সেই ঘরটিতে ফিরে গেলাম। আজ আমি এখন তার সঙ্গে এখানে বসে আছি। কিন্তু আমাদের নিজেদের এতবেশি সুন্দর স্মৃতি নেই। 
আমার মায়ের রুমমেট সেই ছোট্ট বৃদ্ধা মহিলাটি টয়লেটে যেতে চাইলেন। কিন্তু তার বিছানার পাশেই একটি ক্যান রাখা আছে, তবুও ওটা ব্যবহার না করে তিনি তার সাঁড়াশির মতো পা দুটো বাঁকিয়ে বসে থেকে কুঁকিয়েই যাচ্ছেন আর এভাবে তার তলপেট চেপে দীর্ঘসময় বিছানায় কাটিয়ে দিলেন। মনে পড়ে আমার দশমশ্রেণীতে যখন পড়তাম ‘গ্যাস্ট্রোএন্ট্রেরাইটিজ’ শব্দটি বানান করা নিয়ে বেশ ভুগছিলাম; আমি সেদিন সার্ত্রের ‘নজিয়া’ উপন্যাসটি পড়ছিলাম। আর এই বুড়িটির মতো আমি আমার ফোলা পেট চেপে ধরে এভাবেই কুঁকড়ে বসেছিলাম। ওই দিনটি ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের একটি ঠা-া দিন কিন্ত রোদ উঠেছিল। 

বুধবার ৩১
গত কয়েকদিন ধরে আমি শুধু আমার মাকে নিয়েই ভাবছি। কারণ, প্রায় এক বছর হতে চলল তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে আর এসব ঘটাও শুরু হয়েছে। সেদিন স্বপ্নে আমি আমার সার্জির বাড়িটি দেখলাম যেটা এখন সরকারি সম্পত্তি হয়ে গেছে (এটি এখন সাধারণ ঘটনা)। রেইনকোট পরা এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মহিলা আমাদের বাড়ির বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল, তাকে দেখে মনে হলো আমার মা। কিন্তু তিনি আমার মা ছিলেন না। তিনি আমার সামনে যখন উপস্থিত হলেন, বাগানে আমরা যখন মুখোমুখি হলাম, আমি তাকে বললাম, ‘ আপনি পাগল হওয়া বন্ধ করুন’। 
পুরনো দিনের একটি কথা আমার আজকে আবার মনে পড়ছে, রুয়নের কাছাকাছি এলাকায় একজন কসাই ছিলেন, আমার মায়ের কাজিন, তিনি তাকে মজার সুরে প্রায়ই বলতেন- ‘আমি তোর চামড়ার ভেতর দিয়ে তোকে চাবুক মারব’। 

নভেম্বর, রবিবার ৪
আজ আমি যখন রুমে প্রবেশ করলাম, দেখলাম আমার মায়ের রুমমেট সেই ছোট্ট বৃদ্ধা মহিলাটি তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, এরপর তিনি হঠাৎ করে মেঝেতে বসে কান্নায় ফেটে পড়লেন, বললেন- ‘আমি আমার প্যান্টি নোংরা করে ফেলেছি’। ডাইনিংরুমে একটি মহিলা সারাক্ষণ গাইছেন জোরে জোরে, ‘সেই ধোপা মেয়েটি তার ধোয়া কাপড়গুলো তুলে রেখেছে লা লা লা’। এত ফ্যাকাশে চামড়া দেখলেই মন খারাপ হয়। 
শনিবার ২৪
আমার মনে হচ্ছে আমি আমার মায়ের রুমমেট এই বৃদ্ধা মহিলার খ্যানখ্যেনে উচ্চস্বরে কুঁকিয়ে ওঠা টুঁটিটা একবার চেপে ধরি। তিনি সারাক্ষণ কুঁকিয়েই যাচ্ছেন। সেদিন আমার মায়ের জন্য কয়েক জোড়া চপ্পল কিনেছিলাম, যখন সেলসম্যানকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, আমার মায়ের পরার  জন্য কয়েক জোড়া চটি দরকার। সে আমাকে বলল, তার মা-ও আলঝেইমারে ভুগছে; কিন্তু সে খুব নিচুস্বরে কথাগুলো বলেছিল; তাকে দেখে খুব লজ্জিত মনে হচ্ছিল। সবাই লজ্জিত। সবাই বিরক্ত। 
আজ আমার তার মুখের লোমগুলো পরিষ্কার করে দিলাম আর হাতের নখগুলোও কেটে দিলাম। এরপর চপ্পল পরার পালা। তাকে চেষ্টা করতে বললাম, আমার কথা শুনে তাকে আতংকিত মনে হচ্ছিল। তিনি খুব ভয় পাচ্ছিলেন। আমার কথা বুঝতে পারছিলেন না। আমি তাকে যা নির্দেশ দিচ্ছিলাম, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না বলে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন- আমি তার উপর রেগে যেতে পারি। আমি বলছিলাম, ‘এটার ভেতর আপনার আংগুলগুলো ঠেলে দিন। এটা এভাবে পরুন। এভাবে চেষ্টা করুন। জুতাগুলো পায়ে দিন। চেষ্টা করতে থাকুন যতক্ষণ না পরতে পারেন। আপনাকে পরতেই হবে’- এরকম আরো কতকিছু। এটা আমার মায়ের অসুস্থতাই এবং পরে আমার প্রেমিক ‘এ’ এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক, যা আমাকে মানবজাতির শরীরিক ব্যথা-বেদনা এবং মনের কষ্ট দুটোর সঙ্গেই একাত্ম হতে এক প্রকারের সহযোগিতা করেছিল। 
আমাকে একটা স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়- একটি বড় জানালার সামনে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে ( অবশ্যই সেই নারীটি আমি) যার সামনে বিশাল খোলা মাঠ। বসন্তের এক দিনে, সূর্যের আলোতে ভেজা দারুণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। এবং এই দৃশ্যটি আমাকে ডরোথিয়া ট্যানিংয়ের জন্মদিনের উপর আঁকা একটি চিত্রকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়; সেই চিত্রকর্মটিতে নগ্ন স্তনসহ একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, যার পেছনে অনেকগুলো দরজা অনন্তের দিকে প্রসারিত। 

ডিসেম্বর, রবিবার ২
আমার মায়ের মুখের ত্বকে কিছু কালো কালো ছোপ দেখতে পেলাম। হ্যা, এর সামান্য একটু আমার ত্বকেও দেখা দিচ্ছে- এটা ঠিক সেই রকমেরই একটা অভিব্যক্তি যা আমি বৃদ্ধপল্লীর বয়স্কলোকদের মাঝে দেখেছিলাম, যখন আমরা স্কুলের সহপাঠীরা ক্রিসমাসের কয়েকদিন আগে সেখানে গলা ফাটিয়ে ক্রিসমাস ক্যারোল গাইতে যেতাম- স্তুতি গান, আনন্দ সংগীত পরিবেশন করতাম। আমার মাকে আজ চেয়ারে বা বিছানায় বসাতে পারলাম না কিন্তু তিনি আমার হাত ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মৃতলোকেরা তার সঙ্গে আজকাল কথা বলে। প্রায়ই তারা অন্য জগৎ থেকে এসে তার সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে। কিন্তু তিনি কখনোই আমার বাবাকে নিয়ে একটিও কথা বলেন না। বাবাকে নিয়ে কিছুই দেখেননি তিনি। 

রবিবার ৯
এই হাসপাতালের সব জায়গায় ঘড়ি আছে, হলরুম, ডায়নিংরুম, বেডরুমগুলোতে কিন্তু এর কোনোটি ঠিক সময় দেয় না- যেন চারটার পরিবর্তে ছয়টা বাজে, ছয়টার পরিবর্তে সাতটা... তারা কি ইচ্ছে করেই এটা করে? 
আমার মায়ের ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধ হওয়া মানেই কি বিবর্ণ হওয়া? ত্বক স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছ হওয়া? জ্যাকেহিঁ বেড়ালটার বয়স বারো, ও খুব বর্ণহীন। আজ যখন আমরা রুমে বসেছিলাম, তিনি ঘোরে ডুবেছিলেন। বললেন, এই ঘরে অন্য অনেক লোক আছে। তিনি কল্পনা করতে লাগলেন, আমাদের আশেপাশে অন্যান্য লোক রয়েছে। মুখে বললেন, ‘চিন্তা করো না। তারা সবাই কাস্টমার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে যাবে। এরা যারা আছে- এদের অর্ধেক তো টাকা না দিয়েই ভেগে যাবে’। এগুলো আমাদের অতীত দিনের কথা। আমাদের জীবনের কথা। 
আমার মায়ের রুমমেট সেই ছোট্ট বুড়িটা চলে গেছে, তার আলমারীর তাকগুলো খালি। উনার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না। (চলবে...)

×