
বাঙালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে ক’জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে শেখ ফজলল করিম হলেন অন্যতম।
‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে’ তা বহুদূর,
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেই সুরা সুর।’
কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য বিশারদ, কাব্য রতœাকার, নীতিবাদী সাহিত্যিকের ১৩৯তম জন্মবার্ষিকী অতিক্রান্ত হতে চলেছে।
কবি শেখ ফজলল করিম লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমীর উল্লা সরদার ও মাতার নাম কোকিলা বিবি। শৈশবে কাকিনা স্কুল থেকে ১৮৯৯ খিস্টাব্দে শেখ ফজলল করিম মধ্য ইংরেজী পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রংপুর জেলা স্কুল থেকে তিনি মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় কাকিনা স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয় কালীগঞ্জ উপজেলার বিন বিনিয়া গ্রামের গনি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরণ নেসা খাতুনের সঙ্গে (মৃত্যু ১৯৬২ খ্রি)। অতঃপর নানা কারণে তার স্কুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। দাম্পত্য জীবনে দুই পুত্রের জনক ছিলেন কবি। তাঁর প্রথম পুত্র মাত্র ৩ দিন জীবিত ছিল। দ্বিতীয় পুত্রের নাম মতিয়ার রহমান। কবি শেখ ফজলল করিম ১৯০১ খিস্টাব্দে থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমভি কোম্পানিতে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনচেতা ফজলল করিম কোম্পানির মন যুগিয়ে কাজ করতে না পারায় স্বীয় চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ত্রিশের দশকে শেখ ফজলল করিম ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মুন্সী মেহেরউল্লাহর (১৮৬১-১৯০৭ খ্রিঃ) অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পেয়ে ছিলেন। সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার পথে ধাবমান শেখ ফজলল করিম কাকিনায় নিজ বাড়িতে তাঁর পীর সাহেব হযরত মাওলানা মহম্মদ শাহ সাহাব উদ্দীনের নামানুসারে তৎকালীন প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস।’ তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত লেখার জগত নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন।
তাঁর সাহিত্যিক জীবনের উন্মেষ ছোটবেলা থেকেই। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি ‘সরল পদ্য বিকাশ’ কবিতা গুচ্ছ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি আজীবন সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে ধর্ম ও নীতি শাস্ত্র বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ কবিতা ও গদ্য লিখে তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম উপাখ্যান, মুসলিম জীবন ইত্যাদি ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়, ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আহমেদিয়া লাইব্রেরি’ নামক একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলের বাধাধরা নিয়মকানুন তাঁর কখনই ভাল লাগেনি। তবে বাইরের প্রচুর বই অধ্যয়নে তাঁর অনীহা ছিল না। বিশেষ করে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রচুর জ্ঞান পিপাসা ও অনুশীলন তাঁর লেখার জগতকে সমৃদ্ধি করেছে। শেখ ফজলল করিমের সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ধর্মীয় হলেও দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা ও সাহিত্যিক প্রসাদ গুণে তাঁর সৃষ্টি সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। শেখ ফজলল করিমের পরিচিত মূলত একজন কবি হিসেবে কিন্তু আমরা দেখি তিনি কবিতা ও কাব্য ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস গবেণষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ গঠনমূলক তত্ত্বকথা, গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতি কথা, চরিত গ্রন্থ এবং বিবিধ সমালোচনামূলক রচনা, সাহিত্যের সকল শাখায় ছিল তাঁর পদচারণা।
ইসলাম প্রচারক, নবনুর, কোহিনুর, বাসনা, মিহির ও সুধাকর, ভারতবর্ষ, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শিশুসাথী, কল্পতরু, মোসলেম ভারত, সোলতান, মাসিক মোহাম্মদী, আলহক, বসুমতি ইত্যাদি পত্র পত্রিকায় ফজলল করিমের অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস, কাব্য, জীবনী, আলোচনা, সমালোচনা ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সমকালীন মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১ খ্রি:) নেতৃত্বে যে নবতর সাহিত্য প্রচেষ্টার উন্মেষ এদেশে ঘটেছিল তাঁর সার্থক ধারক ও বাহক ছিলেন শেখ ফজলল করিম, জীবিতকালেই তিনি পেয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি। ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্যপদক পান। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাঁকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ‘চিন্তার চাষ’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন নীতি ভূষণ উপাধি। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে খিদিরপুর মাইকেল লাইব্রেরি মধুস্মৃতি কবিতার জন্য তিনি রৌপ্যপদক পান। ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সরকারের লঁঃব জবংঃৎরপঃরড়হ রৌপ্যপদক তিনি পেয়েছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে। এ ছাড়াও তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁকে দিয়েছিল কাব্যভূষণ, সাহিত্যরতœ, বিদ্যাবিনোদ, কাব্যরতœাকর উপাধি ও সম্মান।
শেখ ফজলল করিম কাকিনা থেকে ‘বাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মে’ মাসে। ‘বাসনা’ পত্রিকাটি দু’বছর চালু ছিল। সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমান মিলন সম্ভব এটি ছিল তাঁর অভিমত। এই পত্রিকায় হামেদ আলী, শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তসলিম উদ্দীন আহমদ (রংপুরের প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট) এবং আরও অনেক স্বনামখ্যাত ব্যক্তির লেখা প্রকাশিত হতো। ওই সময় ‘বাসনা’ পত্রিকাটি ছিল পূর্ববঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা। বিভিন্ন সূত্র থেকে শেখ ফজলল করিমের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা অনুযায়ী আমরা তার ৫৮টি রচনার সন্ধান পাই।
কবির স্বর্গ ও নরক নামের কালজয়ী কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’ ও কবি ‘মালঞ্চ’ নামক দুটি স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ও গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ম্যাট্রিক ক্লাসের জন্য তাঁর কবিতা পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক?’ বিখ্যাত কবিতার কবি হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে তিনি আজও সুপরিচিত। লালমনিরহাট তথা বাংলার গৌরব শেখ ফজলল করিমের অনেক পান্ডুলিপি কলকাতার নূর লাইব্রেরিতে প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। সেগুলো কোথায় আমরা তা জানি না। খোঁজ করলে হয়ত কবির আরও অনেক রচনার সন্ধান পাওয়া যাবে। নবীন গবেষকদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাই।
পল্লী বাংলার নিভৃত কোণে শেখ ফজলল করিম নিরলসভাবে সাহিত্য সাধনা ও জ্ঞানচর্চা করেছেন। দীর্ঘ রাত পর্যন্ত তিনি জেগে থাকতেন। কখনো হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠে পেন্সিল দিয়ে হাতের কাছে পাওয়া যে কোন কাগজে লিখে রাখতেন মনের মধ্যে উত্থিত ভাবের কথা। বিছানায় তাঁর সঙ্গে পেন্সিল ও পেন্সিল কাটার ছুটি থাকত সব সময়। আশপাশের জ্ঞানপিপাসু মানুষ প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। এদিক থেকে তিনি ছিলেন বিশেষ ধরনের মানুষ যার ছিল জ্ঞান আদান প্রদানের মহৎ ভাবনা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি গজলের ভক্ত ছিলেন। নিজেও বেশ কিছু বাংলা গজল লিখেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে অবিভক্ত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙালী মুসলমানদের অবস্থান মোটেও সুদৃঢ় ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সুস্থ মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। কবি শেখ ফজলল করিম সে সময়ে কবি বা গদ্য লেখক হিসেবে তিনি তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে সুপরিচিত হয়েছিলেন। এটা তাঁর অসীম কৃতিত্বের পরিচয়।
লালমনিরহাট তথা বাংলার গৌরব শেখ ফজলল করিমের অনেক পান্ডুলিপি কলকাতার নূর লাইব্রেরিতে প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। সেগুলো কোথায় আমরা তা জানি না। খোঁজ করলে হয়ত কবির আরো অনেক রচনার সন্ধান পাওয়া যাবে। নবীন গবেষকদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাই।
বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক শেখ ফজলল করিম ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে শেখ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কাকিনায় নিজ ভবনে তিনি চিরশায়িত আছেন।