ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৭ আগস্ট ২০২৫, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২

ইরানকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যুদ্ধবিমান দিতে তৈরি চীন

প্রকাশিত: ২১:৫০, ৬ আগস্ট ২০২৫

ইরানকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যুদ্ধবিমান দিতে তৈরি চীন

ছবি: সংগৃহীত

১৩ জুন, ইরানের স্থানীয় সময় ভোররাত—একটি বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে তেহরান। মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে যায়, এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়—বরং পরিকল্পিত হামলা। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা নিহত হন একের পর এক। একইসঙ্গে হামলা হয় নাতান্স, ইসফাহানসহ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায়। হামলার নাম—অপারেশন রাইজিং লায়ন, এবং এই হামলার পেছনে যে ইসরাইল রয়েছে, তা বুঝতে ইরানের বেশি সময় লাগেনি।

চুপ করে বসে থাকেনি তেহরানও। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনীর হুঁশিয়ারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরাইল অভিমুখে ছোড়া হয় শত শত ক্ষেপণাস্ত্র। টানা ১২ দিন ইরান-ইসরাইল মুখোমুখি সংঘাতে উত্তাল হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য। তবে এই যুদ্ধ কেবল ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি ইরানের সামরিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতাও উন্মোচন করে দিয়েছে।

যদিও ইরানের সাধারণ মানুষ বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা, বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঘাটতি এবং ভুল কূটনৈতিক হিসাবনিকাশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

প্রথমত, ইরানের বিমান বাহিনীর ভয়াবহ অবস্থা স্পষ্ট হয়েছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে ফ্লিটের আধুনিকায়ন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এখনো তাদের ভরসা এফ-৪ ফ্যান্টম ও এফ-৫ টাইগার নামের তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, যেখানে ইসরাইল অপারেশন রাইজিং লায়নে ব্যবহার করেছে পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক F-35।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের বিমান বাহিনী আজ "ফ্লাইং মিউজিয়াম" এ রূপ নিয়েছে। এর পেছনে শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং ইসলামিক শাসকদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও আইআরজিসি (ইরান রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস)-কে প্রাধান্য দেওয়ার ব্যর্থ কৌশলও দায়ী। ফলে দুটি সক্রিয় সামরিক কাঠামো—প্রথাগত বাহিনী ও আইআরজিসি—এর মধ্যে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা স্পষ্ট হয়েছে যুদ্ধের সময়।

এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। একদিকে তেহরানের ভিতরে তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, অন্যদিকে প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক হ্যাকিং ও নজরদারি ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে ইরান কার্যত একাধিক দিক থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ও আইআরজিসির মহাকাশ শাখার প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহ সরাসরি বলছেন, ইরানের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে মোসাদ।

এতকিছুর পরেও ইরান চুপ থাকছে না। পশ্চিমাদের GPS ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় ইরানি নৌবাহিনী এখন ঝুঁকছে চীনের Beidou নেভিগেশন সিস্টেমে। এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত পছন্দ নয়, বরং পশ্চিমাদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার স্পষ্ট বার্তা।

শোনা যাচ্ছে, ইরান চীন থেকে উন্নত প্রযুক্তির SAMs ও যুদ্ধবিমান (AWACS) কিনতে চাচ্ছে। তবে এই উদ্যোগ কি সফল হবে? প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কারণ, চীনের এমন পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হবে, যা চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়াতে পারে।

বিশ্ববাজারে চীনা প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে এমনিতেই আশঙ্কায় রয়েছে ওয়াশিংটন। সেই প্রেক্ষাপটে ইরান-চীন সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে।

সবমিলিয়ে, এই ১২ দিনের ইরান-ইসরাইল সংঘাত শুধু একটি যুদ্ধ নয়—এটি ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা, যেখানে ইরানকে তার নিজের সামরিক ব্যর্থতা, গোয়েন্দা দুর্বলতা, কূটনৈতিক অন্ধতা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব একসাথে মোকাবিলা করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা ইরানের জন্য যে কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে, তা সময়ই বলে দেবে।


শেখ ফরিদ

×