ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৭ আগস্ট ২০২৫, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রশ্নে আবারও আলোচনায় জিন-সম্পাদিত শিশু!

প্রকাশিত: ০০:১৫, ৭ আগস্ট ২০২৫

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রশ্নে আবারও আলোচনায় জিন-সম্পাদিত শিশু!

২০১৮ সালে চীনের বিজ্ঞানী হি জিয়াঁকুই গোপনে বিশ্বের প্রথম জিন-সম্পাদিত শিশুর জন্মের দাবি করে বিজ্ঞানজগতে এক বিস্ফোরণ ঘটান। তখন এ ঘটনাকে বিপজ্জনক, অনৈতিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসেবে দেখা হয় এবং বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে তখনকার জ্ঞান ছিল সীমিত। চীনের চিকিৎসাবিষয়ক নীতিমালাভঙ্গের অভিযোগে ওই বিজ্ঞানীকে তিন বছরের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল।

সেই বিতর্কিত অধ্যায় পেরিয়ে এখন আবারও সামনে আসছে জিন-সম্পাদিত শিশু তৈরির উদ্যোগ। যদিও বিশ্বের অধিকাংশ বিজ্ঞানী এখনো অত্যন্ত সতর্ক গবেষণাকেই উৎসাহ দেন এবং মানবশিশুর জিন সম্পাদনার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে, তবুও একদল উদ্যোগপতি ও প্রযুক্তিপ্রেমী বিনিয়োগকারী ভবিষ্যতের সংকট বিশেষ করে জন্মহার হ্রাস ও জিনগত রোগের ঝুঁকি দূর করতে এই ক্ষেত্রে নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

প্রাইভেট কোম্পানির এগিয়ে আসা

‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ নামে একটি নতুন সংস্থা জিন সম্পাদনার মাধ্যমে শিশুদের স্বাস্থ্য, বুদ্ধিমত্তা এবং চেহারা উন্নত করার চিন্তা করছে। প্রতিষ্ঠাতা ক্যাথি টাই জানিয়েছেন, তারা এই গবেষণা চালাতে চান ‘স্বচ্ছতা, সদ্‌ইচ্ছা এবং আলোকবর্তিকা’ হিসেবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে।

প্রাথমিকভাবে তারা মাউসের ওপর পরীক্ষা চালাবে, তারপর ধাপে ধাপে প্রাইমেট ও মানব কোষে প্রয়োগ করবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জানাতে চায় এই প্রযুক্তি কী করতে পারে এবং এর সীমাবদ্ধতাই বা কী। নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ভবিষ্যতে মানব ভ্রূণে গবেষণার অনুমতি পেতে পথ খুলে যাবে বলেই তাদের আশা।

তাদের দাবি, লক্ষ্য শুধুই জিনগত মারাত্মক রোগ যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস বা বিটা থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ। অর্থাৎ, গবেষণার সীমা নির্ধারিত থাকবে রোগ প্রতিরোধের মধ্যেই।

 

বিনিয়োগকারীদের নতুন ভাবনা

বিশ্বের নানা প্রান্তে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা এই গবেষণাকে ‘নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিতভাবে’ চালানোর পক্ষেই মত দিচ্ছেন। সান ফ্রান্সিসকোর SciFounders-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা লুকাস হ্যারিংটন বলেন, “বেস এডিটিং”-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধে আরও কার্যকর হয়ে ওঠা সম্ভব।

অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Bootstrap Bio-এর প্রধান নির্বাহী চান্স ডেনেক বলেন, “মানুষকে শুধু অসুস্থতা থেকে রক্ষা করাই নয়, বরং তাদের জীবনমান উন্নত করাই আমাদের লক্ষ্য।” অর্থাৎ, রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও শিশুদের জেনেটিক উন্নতিতে আগ্রহী অনেকেই।

 

বিজ্ঞানীদের দ্বিধা ও সতর্কতা

অনেক গবেষকই মানব ডিম্বাণু ও ভ্রূণের জিন সম্পাদনার সীমিত ও নিরাপদ গবেষণার পক্ষে। তবে ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ভ্রূণ গবেষণায় সরকারি তহবিল প্রদান করে না, ফলে বেসরকারি সংস্থারাই মূল ভরসা হয়ে উঠছে।

তবে অনেক জৈবনৈতিক বিশেষজ্ঞ (bioethicist) হুঁশিয়ার করছেন এই প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাঙ্ক গ্রীলি বলেন, “যখন প্রজননের প্রশ্ন আসে, ভুলের খেসারত দিতে হয় শিশুকেই।” অর্থাৎ, ভবিষ্যতের শিশু অনিশ্চিত জিনগত পরিণতির শিকার হতে পারে।

আরিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেন হুরলবার্ট বলেন, “শুধু আপনি কিছু করতে পারছেন, সেটা মানে এই নয় যে সেটা আপনাকে করতেই হবে।”

প্রযুক্তির বাজারায়ন ও সমালোচনা

এই গবেষণাকে কেন্দ্র করে জিনগত ইউজেনিক্স বা উন্নত মানব জাতি গঠনের পুরনো বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এ ধরনের উদ্যোগ মানুষের প্রজননকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার চেষ্টা, যেখানে সন্তান জন্মকে দেখা হচ্ছে এক ধরনের ‘পণ্য উৎপাদন’ হিসেবে।

বায়োইথিকিস্ট ফ্রাঙ্কোইসে বাইলিস ও কেটি হ্যাসনসহ অনেকে কড়া সমালোচনা করে বলছেন, এটি এক প্রকার ‘আধুনিক ইউজেনিক্স’, যেখানে মানব ভবিষ্যৎকে প্রযুক্তি ও মুনাফার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

২০১৮ সালের সেই গোপন চীনা গবেষণার ঘটনায় বিশ্ব যেভাবে বিস্মিত হয়েছিল, আজ তা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রযুক্তি এগুচ্ছে একটু বেশি স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। যদিও বিতর্ক এখনো রয়েছে, তবু প্রশ্ন উঠছে যদি প্রযুক্তি সত্যিই নিরাপদ হয় এবং মানবজাতিকে মারাত্মক জিনগত রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে, তবে সেটা ব্যবহার করাই বা অন্যায় কেন? এখন সময়, বিজ্ঞান, নীতিমালা ও মানবিক বিবেচনার

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/mrynpeya

আফরোজা

×