ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আবু আফজাল সালেহ

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি

প্রকাশিত: ০০:১৫, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি

সারাজীবন বেশিরভাগই প্রকৃতির কবিতা লিখেছেন মূলত তারাই প্রকৃতির কবি। প্রকৃতির কবিতা সারাজীবন প্রকৃতির ভেতর দিয়েই গ্রহণ করেছেন। বিশ্বসাহিত্যে এমন কবির সংখ্যা নিতান্তই কম। এই হিসেবে বাংলাসাহিত্যে আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দকেই খুঁজে পাওয়া যায়। তার কবিতায় প্রকৃতির বৈচিত্র্য রয়েছে, প্রকৃতির বিভিন্নরূপ রয়েছে। জীবনানন্দের নিজস্ব-দৃষ্টি ও সৃজনীশক্তি সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে। পঞ্চইন্দ্রিয়ের পাশাপাশি আরও অনেক ইন্দ্রিয় কাজ করছে। মনে হয়, এক্ষেত্রে তিনি অজস্র মাছির চোখের মতো পর্যবেক্ষণ করেছেন। সাধারণ দৃষ্টিকেও তিনি অসাধারণ সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। এ বৈশিষ্ট্য কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও কথাশিল্পেও লক্ষ্য করা যায়। জন কীট্স, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, পার্সি বিসি শেলী প্রমুখ বিশ্বসাহিত্যের প্রকৃতির কবি, রোমান্টিক কবি বলা হয়। উল্লিখিত কবিদের কবিতায় সবুজ তৃণভূমি, বনাঞ্চল, বিভিন্ন ফুল ও ফল, পাহাড়-পর্বত, নদীর বিভিন্ন রূপ, সাগর, গ্রামীণ দৃশ্য, বিভিন্ন প্রকার বায়ু ও রূপ, সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়, সৈকত ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির দেশজ উপাদান লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতায় কার্তিকের রূপ, জ্যোৎস্না, শালিক-চিল-সহ দেশীয় পাখি, ধানসিঁড়ি-সহ বিভিন্ন নদী, লজ্জাবতী, দখিনা বাতাস ইত্যাদি। এসব দিয়ে তিনি কবিতায় শব্দবুনন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং নান্দনিক চিত্রকল্প নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের মতো তিনিও প্রকৃতির মধ্যে রোমান্স সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতি ও প্রেমের মধ্যে সাঁকো বেঁধে রোমান্টিক-আবহ সৃষ্টি করে চমৎকার সাহিত্যিক পরিবেশ নির্মাণ করেছেন। John Keats’i ‘A thing of beauty is a joy for ever’ যেন জীবনানন্দের পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। এটা শুধু নীড় নয়, এটা আস্থা ও শান্তির জায়গা-যার মাধ্যমে জীবনানন্দ আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেতে চেয়েছেন। কীট্স কবিতায় বলেছেন, In deepest grass, beneath the whisp’ring roof Of leaves and tremled blossoms, where there ran... Blue, silver, white, and budded Tyrian, They lay calm-breathing on the bedded grass; (Ode to Psyche) William Words worth প্রকৃতির আর একজন নন্দিত কবি। তাকে প্রকৃতির যাজক বলা হয়। তার চোখে প্রকৃতি হচ্ছে বড় শিক্ষক, একইসঙ্গে বন্ধু, পথপ্রদর্শক এবং অভিভাবক। তিনি প্রকৃতিকে নৈতিকতার সঙ্গে বন্ধন দিয়েছেন, প্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের যোগসূত্র নির্মাণ করেছেন। Knowing that nature never did betray the heart that loved her; tis is her privilege, Through all the years of this our life, lead from joy to joy...(Daffodils, 122-125) প্রকৃতি ও প্রেমের আর একজন বিশ্ববিখ্যাত কবি পার্সি বিসি শেলী। তিনি প্রকৃতি প্রেমিক। প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা তার কবিতার অন্যতম প্রধান উপাদান, অন্যতম সুর। তার ‘Ode to the West Wind’ কবিতা থেকে, What objects are the fountains Of thy happy strain? What fields, or waves, or mountains? What shape of sky or pain (71-74) কীট্সের ভাষায় A thing of beauty is a joy for ever বা শেলী ঝরনা, বিস্তীর্ণ মাঠ, পর্বত ইত্যাদিকে উপভোগ বা সুখী হওয়ার উৎস মনে করতেন। তিনজন বিখ্যাত কবির তিন রকম প্রকৃতির উপাদান- ওয়ার্ডসওয়ার্থের ড্যাফোডিল ফুল, কীটসের নাইটিঙ্গেল পাখি, শেলীর পশ্চিম বায়ু-নিয়ে কবিতাংশ তুলে ধরেছি। এগুলো কবিতায় প্রকৃতির উপাদানের প্রতিনিধি হিসাবে ধরে নিতে পারি। তারা প্রকৃতিকে সৌন্দর্যের আধার বা শক্তি বলে মনে করতেন। প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছেন- যাকে আমরা ধবংঃযবঃরপরংস বা নান্দনিকতাবাদ বা সৌন্দর্যানুরাগের প্রয়োগ বলতে পারি। নান্দনিকতা হলো একটি শিল্প দর্শন; সাহিত্য ও শিল্পকলায় প্রকৃতির অধ্যয়ন। সৌন্দর্যের বিকাশ/ বিচারে এর মানদ- নিরূপণ করা হয়। জীবনানন্দ কবিতায় আর্টের সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটিয়ে একটি সুখের (মন ও চোখের) স্বর্গ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তার কবিতায় (প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার বেশিরভাগই) সিরিজ/পরম্পরায় প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করেছেন। তার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ। প্রকৃতির প্রয়োজনেই এসব ব্যবহার করেছেন তিনি। আমাদের জীবনানন্দকেও আমরা প্রকৃতির কবি বলতে দ্বিধা করব না। বরং উল্লিখিত তিন বিশ্বসাহিত্যিকের কবিতার সমন্বয় বলব জীবনানন্দের কবিতা। জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, রোমাঞ্চ, সৌন্দর্য প্রভৃতি। তার কবিতায় বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির রূপ পাঠকের মনে এক দোলা দেয়-যা রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। প্রকৃতির উপাদানে চিত্রকল্পনির্মাণে কবি জীবনানন্দ দাশের পঞ্চইন্দ্রিয় সতত ও সমভাবে সক্রিয়। ‘বাঙালী নারীর কাছে-চাল-ধোয়া স্নিগ্ধ হাত, ধান-মাখা চুল,/হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড়,-ডাঁশা আম কামরাঙা ফুল’, ‘হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখার মতো’, ‘বিনুনি বেঁধেছে তাই-কাঁচপোকাটিপ তুমি কপালের ‘পরে’, ‘কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায়’ ইত্যাদি প্রকৃতির উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। অঘ্রান-কার্তিক কবির প্রিয় সময়। বিভিন্ন উপকরণে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে বিভিন্নরূপে। চিল-হরিণ-জোনাকি-বেড়াল-বাদুড়, চাঁদ-নক্ষত্র-আকাশ-সাগর-নদী, ডানা-লতা-ঠাং-শরীর-পালক, ঘ্রাণ-ঘুম-নির্জনতা, হিজল-ঝাউবন, লেবু-আমলকী-দেবদারু, পাতা-ঘাস-ধান, বালি-শিশির-হাওয়া-রোদ-জ্যোৎস্ন্যা, ঝড় ঢেউ, নীল-সবুজ হলুদ ইত্যাদি ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের কবিতাগুলোতে। বিভিন্ন পাখির প্রসঙ্গ এসেছে তার কবিতায়। বিভিন্ন রঙের শালিক, চিল, খঞ্জনা, চড়ই, বিভিন্ন পেঁচা, শঙ্খচিল, বিভিন্ন কাক, ফিঙে, বউ-কথা-কউ, বক, দোয়েল, শ্যামা, খঞ্জনা, ঘুঘু, কাঠঠোকরা প্রভৃতি কবিতায় প্রকৃতির রূপ দিয়েছে। কবিতায় অরণ্যের রূপ দিয়েছেন নীলগাই, চিতা, সাপ, বাঘিনী, হরিণ, শম্বর, ঝিঁ ঝিঁ ইত্যাদি উপস্থিত করে। বন, বিভিন্ন প্রকারের গাছ-গাছালি, ফুল-ফল, জলকর, মেঘ, আকাশ-বাতাস, কীটপতঙ্গ, ঘাস ইত্যাদির পাশাপাশি ইঁদুর, বেড়াল, বিভিন্ন প্রকারের মাছ, বিভিন্ন ফড়িং, কাঁচপোকা, মউমাছি ইত্যাদি প্রয়োগের প্রকৃতির নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন। কাঁঠাল, জাম, আনারিস, ডুমুর, জারুল, হিজল, অশ্বত্থ, শিমুল, নারিকেল, লিচু, দারুচিনি, তেঁতুল, শিশু, পলাশ, চালতা প্রভৃতি গাছ ও ফুল-ফলের উপস্থিতি মুগ্ধ করবে। ‘ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরা’, ‘আকন্দফুলের কালো ভীমরুল, আলোকলতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণফুল বাসকের গায়’, ‘চালতাফুল কি আর ভিজিবে না’, ‘ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো’, ‘নীল অপরাজিতার মতো’, ‘চড়াই পাখি কাঁঠালীচাঁপার নিচে ঠোঁট আছে গুঁজে’ ইত্যাদির মতো ফুল ও ফলের বর্ণনা কবিতাকে নান্দনিকতা দিয়েছে- চোখের পাশাপাশি অন্তরের- মনে দারুণ সব ছবি এঁকে দেয়; যা মনে থাকে অনেকদিন। ‘খইয়ের ধানের মতো আমি দেখিয়াছি ঝরে ঝ্র ঝ্র’, ‘অস্ফুট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভেতর’, ‘গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ’, ‘কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে প’ড়ে যায় শ্যাওড়ার ঝাড়ে’ (পৃথিবীর পথে আমি), ‘দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে, ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু’, আকন্দবনের ভিড়, মাকাল লতার তল, শিশিরের নীল জল, ন্যাড়া অশ্বত্থ, টস্টসে ভিজে জামরুল, নরম জামের মতো চুল, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল, কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো, আকাশে ‘নরম ধানের গন্ধ’-কলমীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের ইত্যাদি প্রকৃতির চিত্র বা উপাদান তার কবিতায় দেখা যায়। জীবনানন্দের দৃষ্টি তিমিরভেদী, খুবই স্বচ্ছ। বাইফোকালের মতো তার ঃড়ি-ভড়ষফ ংবহংব দারুণভাবে কাজ করেছে। একটি অন্তর্নিহিত চোখে আর একটি বহির্দৃশ্যের ছবি। দুটির সমন্বয়ে অসম্ভব প্রিয় সব চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। পর্যবেক্ষণের জন্য মাছির মতো অজস্র চোখ ও ইন্দ্রিয় কাজ করে। কথা দিয়ে ছবি এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতা বুদ্ধিগত প্রয়োগের চেয়ে অনেক বেশি ইন্দ্রিয়গত বিষয়। ভালকবিতার মধ্যে একটি নান্দনিকতা রয়েছে, অপূর্বতা রয়েছে। মনে হয় এ যেন সদ্যোজাত অথচ চিরন্তন। এমন কবিতায় থাকে সুর আর সুরে থাকে অখ-তা। জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো ঠিক এমনই। না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়, পড়লে পড়ার তৃষ্ণা বেড়ে যায়। মনের মধ্যে যে বেড়ি দেয়া আছে তা খুলে দেয় তার কবিতা। একটি সুরের সম্মোহনী রয়েছে, যা ইচ্ছে করলেও ভোলা যায় না। ভুলতে গেলেও হৃদয়ে হানা দেয়, আরও সুর সৃষ্টি করে। সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিরাট আবেশ তৈরি করে। জীবনানন্দ কবিতায় বাংলা নিসর্গকাব্যের ধারাকে বর্জন করে এখানে একটি নতুন পথ বেছে নেয়া হয়েছে। বাংলা কবিতার চরিত্র বদলে দিয়েছেন। বাংলাসাহিত্যে প্রকৃতির কবিতা মানেই জীবনানন্দের কবিতা। অন্তত মানের দিকে লক্ষ্য রেখে এ দাবি করা সঙ্গত হবে।
×