ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সোহেল মাজহার

যে মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল জননী

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ২৩ মার্চ ২০১৮

যে মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল জননী

মনিরুস সালেহীনের গল্পগ্রন্থ যে মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল জননী। স্বাভাবিকভাবেই গল্পগ্রন্থে বিভিন্ন মেজাজ, মন-মর্জি ও দৃষ্টিভঙ্গির গল্পের সমাবেশ ঘটে। সেদিক থেকে বিচার করলে গ্রন্থটির গল্প নির্বাচনে কোন ব্যতিক্রম নেই। কখন একটি গল্প বা ছোট গল্পের বই আলাদাভাবে চোখে পড়ে? গল্পের বিষয় ভাবনা উপস্থাপনা, বলার ভঙ্গি, তার বৈচিত্র্য, বাক্য বিন্যাসে শব্দের অন্তর্গত খেলা ও বিন্যাস নিশ্চিতভাবে বড় শর্ত। গ্রন্থটিতে মোট ১২টি গল্প স্থান পেয়েছে। শিরোনাম গল্পটিই বলে দেয় লেখকের সত্তায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শাশ্বত অনুভূতি লেখক অনুভব করেন বিশ্বাস দিয়ে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে গিয়ে অধিকাংশ লেখক গতানুগতিক ফাপা গল্প ফাঁদেন। সেখানে কোন নতুন চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশেষ পর্যবেক্ষণ থাকে না। নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবের বিষয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পট এত বিস্তৃত, স্টোরি লাইন এত বিচিত্র যে প্রতিদিন এই বিষয় নিয়ে গল্প লিখলেও তা নতুন থেকে যাবে। গ্রামের বৃদ্ধা দ্বাত্রী মধুর মা, একমাত্র ছেলে মধুকে ছাড়া তার কোন স্বজন নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের একজন খবর নিয়ে আসে তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এই খবর তার ভেতর উৎকণ্ঠা ও গৌরবের বোধ তৈরি করে। নদী দিয়ে যখনই কোন বেওয়ারিশ লাশ ভেসে আসে, সে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। লাশের ভেতর নিজের ছেলের মুখ খুঁজে। এভাবেই চলছিল তার দিন। কিন্তু একদিন ইউনুস আলী নামে এক প্রতিবেশী খবর নিয়ে আসেন, মধু মুক্তিবাহিনীতে নয়, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সংবাদটি মধুর মার কাছে কেবলই মনে হয় গ্রামবাসীর ঈর্ষাজনিত কুৎসা রটনা। ঘটনা পরস্পরায় এক সময় মধুর মা পাগল হয়ে যায়। কিন্তু লেখকের ফোকাস ছিল অন্যত্র। মুধ মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও তার মা সকল মুক্তিযোদ্ধার জননী হয়ে ওঠে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে ছিল সাহস ও গৌরবের। সকল মুক্তিযোদ্ধার মাঝেই সে নিজের সন্তানের প্রতিকৃতি খুঁজে ফিরেছে। তার মাঝে যেমন ছিল মাতৃত্বের শাশ্বত হাহাকার তেমনি ছিল দেশ মাতৃকতার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। তিনি সর্বজনীন মা হয়ে ওঠেন। ফুবটল গল্পে লেখক বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও নিজের শৈশবকালকে নিয়ে আসেন। মূলত তিনি নিজেকে ফুটবলের প্রতিরূপ হিসাবে উপস্থাপন করেন। এখানে একটি মাত্র অর্থই দাঁড়ায় তা হল তার নিজের জীবন কেবল অন্যের প্রয়োজন ও মনোরঞ্জনে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার এই গল্পের মাধ্যমে নিজেকে আত্মপীড়ন করে তুচ্ছ হিসাবে গণ্য করেন। গল্পে মানুষের ভেতর উচ্চ শিখরে পৌঁছা কিংবা অনেকের মাঝে একজন হয়ে ওঠার যে তীব্র বাসনা সেই আকুতি ফুটে ওঠে। বর্শেল গল্পে মূলত উচ্চবিত্ত সমাজের বিকৃতির নগ্নরূপ ফুটে ওঠে। তাই দেখা যায় কেউ কেউ একই সঙ্গে মা এবং নিজ কন্যার বয়সী মেয়ের সঙ্গে নানা রকম সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এই সম্পর্ক যতনা নিজের ভেতর থেকে তৈরি হওয়া, তার চেয়ে বেশি প্রলোভনতাড়িত সঙ্গ লিপ্সা। যে কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এদের কাছে শিল্প। সব সময় তারা একধরনের অসুস্থ সুখে মত্ত হয়। দৌড় গল্পটি অনেক বেশি মানবিক। পারিবারিক আর্থিক টানাপোড়নের ভেতর মানুষের টিকে থাকার লড়াই মুখ্য হয়ে ওঠে। একটি হুমায়ুনীর উপন্যাসের খসড়ার কয়েক পাতা গল্পে লেখক মূলত হুমায়ূন আহমেদের ঢঙ প্রকরণ ও বিষয় ভাবনাকে অনুকরণ করতে চেয়েছেন। ভাষা ও চিন্তার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ আধিবাস্তব কল্পকার জগত ও ভাবকে উপলক্ষ করেন। একই ধরনের আবহ তৈরি করে তিনি নিজের মতো করে একটি গল্প বলার চেষ্টা করেছেন মাত্র। মনিরুস সালেহীন গল্প বলার ক্ষেত্রে একটি অন্তর্গত ভাষাশৈলী অর্জন করেছেন। বলার ভঙ্গি, বিষয়ের বৈচিত্র্য, চিন্তার গতিময়তা, জীবন ও সমাজ দর্শন বিচারে তিনি নিঃসন্দেহে অনন্য কথাকার। গদ্যে একটি সাবলীল ঢঙ ও অনবদ্য ভাষারীতি তিনি প্রয়োগ করেন। পাঠক খুব সহজেই বিষয়ে ভেতরের বিষয়কে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
×