সমকালীন তরুণ কবিদের মধ্যে প্রতিশ্রুতিশীল কবি জব্বার আল নাঈমের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘এসেছি মিথ্যা বলতে’ পবিত্র ঈদ-উল- ফিতর উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রন্থের শিরোনামেই কবি জব্বার আল নাঈম অকপটে স্বীকার করেছেন ‘এসেছি মিথ্যা বলতে’। গ্রন্থ পাঠে আমরা জানতে পারি তিনি কেমন মিথ্যা বলেছেন, কেন বলেছেন এবং কিভাবে বলেছেন। প্রথমেই গ্রন্থটিকে তিনি তিনটি পর্বে ভাগ করে নিয়েছেন। প্রথম পর্ব ‘ট্রাফিকÑবৃষ্টিতে ভিজে’, দি¦তীয় পর্ব ‘রক্তমাখা ইটের গল্প’, তৃতীয় পর্ব ‘গুলবদন ও অন্যান্য কবিতা’। প্রত্যেক পর্ব আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও বক্তব্যে উপস্থাপিত হয়েছে।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম পর্ব ‘ট্রাফিকÑবৃষ্টিতে ভিজে’র প্রথম কবিতায় কবি বলেছেন, ‘অথচ আগের পাঁচ হাজার বছর আর পরের দশ হাজার বছরের জাঁতাকলে আটকে আছি এখনও। নতুন করে শূন্যতার সমান কিছু ভাবছি...’। (মুহূর্তের কথা)
মাঝখানে বসে কবি নিজেকে মধ্যযুগ দাবি করেন। তিনি নতুন করে কিছু ভাবেন। সেই ভাবনাগুলোই কবিতা হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়।
এসেছি মিথ্যা বলতে গ্রন্থে কবিতায় দেশাত্মবোধ ফুটে উঠেছে ভিন্ন মহিমায়। সংগ্রামে-সংক্ষুব্ধতায় এ এক অন্য দেশের কথা বলেন তিনি। কবির ভাষায়,
‘আঙ্গুলের ঠিক সামনেই বিশাল শূন্য মাঠ
পেছনে ষোল কোটি পৃষ্ঠার বেঁচে থাকার সংগ্রাম’ (মানচিত্র)
কোনো কোনো কবিতায় দার্শনিক চিন্তা প্রকট হয়ে ওঠে। অবচেতন মনের নিবিড় আলাপ প্রোথিত হয় কবিতার শরীরে। কবিতায় পূর্ববর্তী পৃথিবী আর পরবর্তী পৃথিবী ধরা পড়ে নিখুঁত চোখে। বর্তমানকে উৎরে গিয়ে কবি ভবিষ্যদ্বাণী করতে চেয়েছেন। আবার কখনো জাতিস্মর হয়ে অতীতের কথাগুলোও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কবি বিবর্তনের বেদনায় জড়ানো সময়-পায়ের তলায় পিষ্ট করতে হেঁটেছেন।
‘রক্তমাখা ইটের গল্প’ পর্বে আবর্জনায় ভরা যন্ত্রণাক্লিষ্ট শহর কবিকে হতাশ করে। তিনি বৃক্ষের ছায়া খোঁজেন। হয়ে ওঠেন পরিবেশবাদী। তার কবিতায় প্রস্ফুটিত হয় বৈশ্বিক চিন্তা। উঠে আসে বর্ণবাদ, আমেরিকা, আফগানিস্তান, ভারত, চীন, রাশিয়া, রোহিঙ্গা ও আরাকান। কবি বলেন,
‘কালো কালি শ্বেতখাতায় লেখে ইতিহাস
মানুষে মানুষে সর্বনাশ!’ (বর্ণবাদ)
‘এসেছি মিথ্যা বলতে’ কবির একটি দীর্ঘ কবিতা। মিথ্যা বলার কারণগুলো তিনি তুলে ধরেছেন। কবি মুক্তি চান। মুক্তবুদ্ধির চর্চার কথা বলেন। মুক্ত মানবতার কথা বলেন। তার কাছে আজকের পৃথিবীটাকে নির্যাতিত মানুষের স্লোগান মনে হয়। এখানে গ্রাম-শহর-বিশ্ব, সমাজ-জাতি-রাষ্ট্র, মানুষ-মনুষ্যত্ব-বিবেক উঠে আসে কৌশলে।
তৃতীয় বা শেষ পর্ব ‘গুলবদন ও অন্যান্য কবিতা’য় কবি নিজেকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করতেও পিছপা হননি। কুকুর পালন করতে আগ্রহী বিত্তশালীকে তিনি নিজের অবস্থানের কথা জানিয়ে সতর্ক করে দিতে চান। এখানে বেকারত্বের নির্মম কষাঘাত ফুটে ওঠে। যেখানে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে; সেখানে প্রতিপত্তিশালীদের ইচ্ছা হয় কুকুর পালবার। যে দেশ একজন মানুষকেই ঠিকমতো ভরণ-পোষণ দিতে পারে না; সে দেশের নাগরিক একটি কুকুর পালবাার জন্য প্রতিমাসে অজস্র্র টাকা ব্যয় করতে পারেন। তাই কবির ক্ষোভ গিয়ে আছড়ে পড়ে নিজের ওপর। সমাজ ব্যবস্থার ওপর।
ঘুমহীন চোখে কবি কত কিছুর কল্পনা করে যান। দৃশ্যকল্পের পর দৃশ্যকল্পে তা তুলে ধরেন পাঠকের সামনে। না ঘুমানো মানুষের ছটফট-হাহাকার মুহূর্তেই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কারো মৃত্যু সংবাদও দুদ- শান্তি দেয় না মানুষকে। সবকিছুই কেমন তাড়িয়ে নিয়ে যায় অসীমের সন্ধানে।
‘দিশেহারা হয়ে শার্ট-প্যান্টের পকেটে ঘুম খুঁজি
ওয়্যার ড্রব, টিভি, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিলের ওপর খুঁজি
কাগজ-কলম ছুড়ে ফেলে কয়েক ঢোক পানি ঢকঢক গিলি
তবুও ঘুমহীন চোখ!’ (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)
এছাড়াও কবির কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। তিনি উত্তর খোঁজেন। কবি জানতে চান কে তোমার আত্মীয়? আমাদের সবকিছুর দূরত্ব কত দূর? আরো অনেক জিজ্ঞাসা। এই যে বৃষ্টিতে ভেজা, মদ খাওয়া, নারীতে সুখ খোঁজা- কতকিছুই না করে মানুষ। আসলে সেকি জানে তার গন্তব্য কত দূর? অথচ কবির ইচ্ছারাও কত ব্যতিক্রম। ভালবাসার মানুষকে সে পায়ে পায়ে দাঁড়াতে শেখাতে চান। নিজের মানুষটিকেও তিনি কারো প্রতি নির্ভরশীল হতে দিতে চান না। সবকিছুকে অতিক্রম করে কবি তার প্রিয়তমাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে চান মানুষের সামনে। সেখানে দেখা যায় সোচ্চার উচ্চারণ, ‘তোমাকে চাই দাঁড় করাতে পায়ে পায়ে।’
কবি তার চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে চান। বৈশ্বিক চিন্তা তার অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে। টালমাটাল বিশ্ব কবিকে ভাবিয়ে তোলে। সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি তাকে অনেক পাঠের আয়োজন করতে বাধ্য করে। নিজের অভিজ্ঞতার চোখে দেখা বিশ্বকে ঠিক নিজের মনের মতো দেখতে পান না। তাই জ্বলে ওঠে ক্ষোভের আগুন। কবি বলেন,
‘এশিয়া-মেরিকায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
পুড়ে গেছে জাপান ধ্বংস বোমে
ফিলিস্তিন উদ্বাস্তু শিবির
বিশ্বাসের খরায়
বিপথে আফ্রিকা
মুমূর্ষু আদিবাসী অস্ট্রেলিয়া
ভেঙে পড়ে মানুষের শির’ (গুলবদন)
তবে ‘এসেছি মিথ্যা বলতে’ গ্রন্থের তৃতীয় পর্বের কবিতাগুলো ‘গুলবদন’কে উদ্দেশ করে বলা কবিমনের অনেক কথা। কবিতাগুলোয় ঘুরে ফিরে গুলবদন এসে হাজির হয়েছেন। বা কবি নিজেই গুলবদনকে বার বার টেনে এনেছেন। হতে পারে গুলবদন তার মানসসঙ্গিনী। হতে পারে অনুপ্রেরণা, আস্থা, ভরসা, ভালবাসা, নির্ভরতার প্রতীক। এই গুলবদন পাঠে আমাদের মনের ভেতর কল্পনার জগতে একেকজন গুলবদনের জন্ম হয়। যে গুলবদন সংসারে, বাস্তবতায়, আঘাতে, অহঙ্কারে, মমতায় সর্বক্ষণ আমাদের পাশে থাকেন। এমনকি ভবিষ্যতেও পাশে থাকবেন। অথচ কবি এও স্বীকার করেন যে, ‘গুলবদন, জানো? কষ্টের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ইতিহাস জানা নেই ফায়ার সার্ভিস কর্মীদেরও।’
কবি জব্বার আল নাঈমের গদ্যনির্ভর কবিতা আমাদের মুগ্ধ করে। তার কবিতায় সুনীল-জীবনানন্দের প্রভাব হয়ত লক্ষ্য করা যায়। বৈশ্বিক নিসর্গ বা মানুষের আরাধনা তুলে আনেন কবি। উদারমনা কবি শুধু কবিতার কথাই ভাবেননি। তিনি ভেবেছেন তার প্রেরণা জোগানো মানুষগুলোর কথা। তাই তিনি বেশ কিছু কবিতা বেশ কয়েকজনকে উৎসর্গ করেছেন। আর পুরো গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন কবি ও অধ্যাপক খালেদ হোসাইনকে।
কবি তার কবিতায় বিষয় নির্বাচনে নতুনত্বের আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন। উপমা প্রয়োগে নতুনতর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন। মুক্তক ছন্দে রচিত হয়েছে অধিকাংশ কবিতা। তবে তাতে ছন্দের ব্যত্যয় তেমন ঘটেনি। কোন কোন কবিতায় পর্ব বিন্যাসে বা মাত্রার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করে উঠতে পারেননি। তবে ব্যাকরণগত সীমাবদ্ধতার পরেও কবিতা পাঠে কিন্তু জড়তা বা দুর্বোধ্যতা পরিলক্ষিত হয় না। কবি যা বলতে চান; পাঠক তা সহজেই বুঝতে পারেন। কবিতার এই সহজবোধ্যতাই তার সহজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে চির জাগরূক থাকবে। কবির সার্থকতা এখানেই। যেমন- ‘গুলবদন’ কবিতাটি পাঁচটি অংশে উপস্থাপন করেছেন। ‘তামাশা ও অন্যান্য কবিতা’টি তিনটি অংশে বিন্যাস করা হয়েছে। ‘কাঁটাতার’ কবিতাটি দুটি অংশে বিভক্ত। এর বাইরেও তিনি বিভিন্ন প্যাটার্ন বা ফর্ম তৈরির চেষ্টা করেছেন। সুতরাং অবশেষে বলাই যায়, কবি মিথ্যা বলতে এলেও আমাদের এক পৃথিবী সত্যকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন। আমরা কবির মিথ্যাকেই সত্য জ্ঞান করে মানবজনম সার্থক করতে পারি। আমি গ্রন্থটির বহুল পাঠ এবং গভীর আলোচনা কামনা করছি।