
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলা অত সহজসাধ্য নয়। যুগ-যুগান্তরের লাগাতার অপসংস্কৃতি নানামাত্রিক বাধা বিঘ্নতার শিকার হওয়া পরিস্থিতির নির্মমতা। সমাজের মূল বৈষম্যই নারী-পুরুষের প্রভেদ। ঐতিহ্যিক চিরায়ত সংস্কার আধুনিকতার নতুন বলয়ে সামনের সারিতে আসা তত কঠিন নয়। তবে দীর্ঘস্থায়ী সমাজ কাঠামোয় নবতর অবস্থান তৈরি স্বস্তি আর নির্বিঘ্নে এগিয়ে যেতে কেমন যেন হিমশিম খায়। আমরা এখন অতিক্রম করছি একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্য গগনে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির উন্নত বিশ্বে মান্ধাতা আমলের প্রাচীন সমাজ বিলুপ্ত হলেও অনেক অপসংস্কার কাঠামোর অভ্যন্তরে জিইয়ে আছে। যা আজও ঠেকানো গেল না। চিরস্থায়ী যন্ত্রণার নিত্য অসহনীয় প্রতিবেশ। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রবাদপুরুষ বিদ্যাসাগর সুদৃঢ় কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন কন্যা শিশুদের বিয়ের পিঁড়ি নয় বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে বই হাতে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর আর এক নারী জাগরণের যোদ্ধা বেগম রোকেয়া ও শুধু কন্যাশিশু বিয়ে বন্ধ নয় বরং নারী শিক্ষার জন্য জোরেশোরে আওয়াজ তুললেন। অবরোধবাসী কন্যাদের পারিবারিক বদ্ধ শৃঙ্খল ভেঙে বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় অনুপ্রবেশ করার উদাত্ত আহ্বান জানালেন।
পরিবারই আদি ও অকৃত্রিম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেই কন্যা শিশুদের যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক মর্যাদায় শুধু সমঅধিকার নয় বই, খাতা, পেন্সিল হাতে দিয়ে নিজেকে তৈরি করার পরিবেশও অত্যাবশ্যক। আর সেটা শুরু করতে হবে ক্ষুদ্র পারিবারিক বলয় থেকে। ভাই-বোনের মধ্যে ফারাক তৈরি নয় মানুষের মর্যাদায় এক কাতারে এসে অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনে বিন্দুমাত্র পেছনে হটলে বঞ্চনার শিকার হতেও সময় লাগবে না। নারী শিক্ষা এগিয়ে আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এক পর্যায়ে বাল্যবিয়ে আর অপরিণত মাতৃত্বকে ঠেকানো অনেকটাই দুঃসহ প্রাচীর। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসারে তেমন কোনো কঠিন বাধা আজ নেই। তবে কন্যা শিশুকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো তেমন চিত্র হটানো গেল না কেন তা প্রশ্নবিদ্ধ তো বটেই। সেখানে বাল্যবিয়ের হার কমলেও সংখ্যায় তা নিতান্ত অপ্রতুল। ফলে বিয়ের সাজে কন্যাটি যখন স্বামীর সংসারে ঘর সাজাতে যায় সেটাও বা কতখানি অনুকূল তাও উঠে আসতে সময় লাগছে না। এরই অবিচ্ছেদ্য ঘটনাক্রমে ‘নির্যাতন-নিপীড়ন’ নামে যে সহিংস আঁচড় বসা তাও সংশ্লিষ্টদের জীবন-মন-শরীর- সবই অপ্রস্তুতই শুধু নয় নষ্ট করে দিতেও খুব একটা সময় লাগছে না। অকাল মাতৃত্বের ভারে শুধু মা নয় নবজাতক ও যে কত দুর্বিপাকে পড়ছে সেটা আর এক দুঃসহ নির্মমতা। এ তো গেল শারীরিক-মানসিক বিপন্নতা। তার ওপর পারিবারিক নির্মম প্রতিবেশ বালিকা বধূটিকে কিভাবে হেনস্তা, হয়রানি আর অমানবিকতার চিহ্ন বসিয়ে দেয় সেটা বলার অপেক্ষাই রাখে না। এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত নির্যাতন আর অত্যাচারের নানামাত্রিক দাবানল। যে শাশুড়ি মা বালিকা বয়সে স্বামীর সংসার করতে কত বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন সেটাও তিনি ভুলতে বসেন। যার কারণে বালিকা পুত্রবধূটি নাওয়া-খাওয়া থেকে সব ধরনের সুস্থ পরিবেশ পেতে ক্রমাগত লাঞ্ছনা, বঞ্চনার শিকার হয়। যা সমাজ সংস্কারের আর এক অলিখিত নিয়ম। অসময়ে মা হওয়াই শুধু নয় অধিক সন্তানের জননী হতেও এক প্রকার বাধ্যই হয়। এ ছাড়াও আছে শারীরিক-মানসিক অবদমন, অপমান, অসম্মান। কচি বয়সে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর সবশেষে নিজের খাবার খেতে বসা আর এক দুর্বিপাক তো বটেই। সবার ভাতের থালায় খাবার দিতে গিয়ে নিজের জন্য কতটুকুই বা অবশিষ্ট থাকে মাঝে মধ্যে তাও প্রকাশ হয়ে যায়। যা সত্যিই বিচলিত হওয়ারই মতো। স্বামী কর্তাটি তো খবরই রাখেন না। পারিপার্শ্বিক পারিবারিক আবহও ততটা স্বস্তিকর নয়। আর ফি বছর সন্তান প্রসব তাও ভিন্নমাত্রার শরীর-মনের ওপর অপরিণত দুর্বিপাক। চিত্রটা মোটামুটি গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের। যা আজও দেশের বৃহত্তম জায়গাজুড়ে সম্প্রসারিত।
নতুন সময়ের অবগাহনে গ্রাম বাংলার নিভৃত পল্লীতে সেভাবে ছোঁয়াটি পাওয়াও দুষ্কর। তবে উন্নয়নের অভিগামিতায় বাংলাদেশ যে একেবারেই পিছিয়ে থাকছে তাও বলা যাবে না। কিন্তু যতখানি প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন অধরা থেকেই যাচ্ছে। তবে নগর, শহর, বন্দরের মতো পল্লি জননীতেও আধুনিকতার নতুন আলো বিকিরণ করছে। কিন্তু সেটা গ্রহণ করার মানসিকতা সেভাবে আগাচ্ছে না বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে। যন্ত্রের সঙ্গে গ্রহণ করার চেতনাবোধ সমান তালে এগিয়ে যেতে না পারলে সমস্যা জিইয়ে থাকার আশঙ্কা পদে পদে। সেখানে সবচেয়ে জরুরি কন্যা শিশুটির শিক্ষা কার্যক্রমে এগিয়ে যাওয়া। যা তার নিজের ভালো-মন্দ বিবেচনা শক্তিকে জাগিয়ে আপন তাগিদেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হবে শিক্ষার প্রসারে যথাযথ বোধ শক্তিও ভেতর থেকে জেগে উঠবে।
নিজেকেই বুঝতে হবে বিয়ের সাজে বধূ নয় বরং ভাইটির মতো বই হাতে বিদ্যালয়ে গমন করে মানুষের মর্যাদায় গড়ে ওঠা। যা কালো আঁধারের মোড় ঘুরিয়ে নতুন আলোয় আগামীর ভবিষ্যৎকে স্বাগত জানাবে। তেমন লক্ষ্যে কন্যা শিশুরা জেগে উঠবে। পরিবার থেকে সর্বংসহা জননীর হাত ধরেই এগিয়ে যাওয়াই নির্মম পরিস্থিতির ন্যায্যতা।
অপরাজিতা প্রতিবেদক
প্যানেল