ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সফল উদ্যোক্তা কাকলি খান

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:৩৭, ২ জুন ২০২৩

সফল উদ্যোক্তা কাকলি খান

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর উর্বর পলিমাটির অপার সম্ভাবনার ব-দ্বীপ

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর উর্বর পলিমাটির অপার সম্ভাবনার ব-দ্বীপ। বীজ মাত্রই এখানে সোনালি ফসলের আবাদে নদীমাতৃক এই অঞ্চলের কদর সেই পুরাকালের। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা চিরায়ত সেই শুদ্ধ কৃষিতে নতুন সময়ের যে মাত্রা যোগ করে তাতে ফসল উৎপাদন বেড়ে গেলেও অনস্যরকম বিপত্তিও কৃষি সভ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টিকর খাবার যাপিত জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত হলেও আধুনিক রসায়নিক সার যেভাবে সহজাত খাদ্যগুণ বিনষ্ট করতে আগ্রাসী ভূমিকা নেয় সেটা বর্তমান সময়ের জনস্বাস্থ্যের হুমকি হিসেবে বিবেচনায় আনছেন পুষ্টিবিদগণ।

আধুনিকতার নির্মাল্যে যান্ত্রিকতার যে লাগাতার যোগসাজশ সেখানে শুদ্ধচাষের সেই চিরস্থায়ী সম্ভারে ফিরে যেতে কাজ করে যাচ্ছেন কাকলি খান। পিতা কাজেম হোসেন রাসায়নিক সারের একজন সফল ব্যবসায়ী। মা সুগৃহিণীই শুধু নন রন্ধন শিল্পেও পারদর্শী পাকা রাঁধুনি। এসব দেখে বড় হয়েছেন কাকলি। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে বিয়ের পিঁড়িতে বসা জীবনের এক অনন্য পর্ব। স্বামী আবসাল শাকিব কোরেশি। দুই সন্তানের জননী কাকলি সংসার সামলিয়ে নজর দেন গ্রামীণ পরিবেশে কৃষিকে শুদ্ধতার আবরণে মুড়ে দিয়ে স্বাস্থ্যবান্ধব ও পুষ্টিসম্মত খাবার মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে। বড় ধরনের এমন প্রকল্প হাতে নেওয়া অত সহজসাধ্যও ছিল না।

বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ নারীদের নিয়ে শুদ্ধ কৃষি ব্যবস্থাকে বেগবান করা অসম্ভব হলেও সময়ের পালাক্রমে সফল হতে দেরি হয়নি। আলাপচারিতায় সহজ, স্বাভাবিকভাবে বলতে লাগলেন এই মহৎ ও বৃহৎ কর্মযোগের শুভযাত্রার সূচনা। শুরু করেছেন দুঃস্থ নারীদের নিজস্ব বসতবাড়ির আঙিনায়। বিভিন্ন শাকসবজির ফলনে রাসায়নিক সার নয় গরুর গোবর বাসি পঁচা পান্তাভাতসহ প্রাকৃতিক হরেক উপাদানে তৈরি সার দিয়েই কৃষিজাত পণ্যগুলোর আবাদে উৎসাহিত করা গ্রামের নারীদের। 
শুধু শাকসবজি নয় মাছ চাষেও আনা হলো সেই পুরনো দিনের চাষাবাদ পদ্ধতি। চাষের ভিন্ন জাতের মাছ নয় বরং পুকুর নদী ও খাল বিলে মাছ উৎপাদনে সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা নজরকাড়া। ফার্ম, পাকিস্তানি মুরগি কিংবা ডিম নয় দেশী মুরগির উৎপাদন নতুন করে খাদ্য পুষ্টিতে যুগান্তকারী অবদান রাখছে। ঘরে হাঁস, মুরগি পালন করে তাদের ডিম থেকেই নতুন মুরগির বাচ্চা ফুটানো এখন এক অবারিত স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার। যাদের বাড়িতে গরু, ছাগলের আধিক্য থাকা তারা দুধ বিক্রি করে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন। এমনকি বছরজুড়ে কোরবানির গরু ছাগল বিক্রি করার ব্যবসাবাণিজ্যেও লিপ্ত আছেন। সঙ্গত কারণে শুদ্ধ এই কৃষি ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। 
সেখান থেকে সার্বিক পণ্য বিভিন্ন স্থানের শোরুমে চলে যায় যা গ্রাহক ভোক্তাদের কিনতে পারাটাও এক স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়। কাকলি আরও জানান তারা শুধু যে কাঁচা পণ্য বিক্রি করেন শুদ্ধ কৃষির আবাদে তা কিন্তু নয় বরং মাঝে মধ্যে বিভিন্ন রান্নার পসরা সাজিয়ে হরেক পরিবারে পরিবেশন খাবার করতেও হয়। ৩০-৪০ জনের রান্নাঘরে বসেই একজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে করাই যায়। তবে বেশি জনের রান্না যেমন কোনো অনুষ্ঠান, পার্বণে বড় ধরনের আয়োজনে দক্ষ রাঁধুনিকে দিয়ে রান্না করিয়ে নেওয়া হয়।

প্রশ্ন ছিল বাবা রাসায়নিক সারের ব্যবসা করতেন- কাকলি নজর দিলেন প্রকৃতি থেকে আসা শুদ্ধ সারের প্রতি কেন? উত্তরে বিমর্ষ সুরে বললেন ফুফু মারা যান দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে। সেখান থেকেই ভাবতে লাগলেন শরীরের রোগ বালাইয়ের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির হরেক উপাদানে কোনো বিষক্রিয়ার সম্পর্ক আদৌ আছে কিনা। ক্রমান্বয়ে নিশ্চিত হলেন সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ খাদ্য সব থেকে জরুরি যা শুধু প্রকৃতি থেকে আসা নির্ভেজাল সারই। আর সেখান থেকেই নিবেদিত হলেন কিভাবে মানুষের জন্য পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারকে নিরাপত্তার বেষ্টনী দেওয়া যায়। লক্ষ্য স্থির করে নিজেকে তৈরি করতে থাকলেন কাকলি। একসময় লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছেও গেলেন।

এখন বাংলাদেশের কিছু কিছু গ্রামীণ পরিবেশে তার শুদ্ধ চাষাবাদের এমন অনন্য কর্মযোগে শুধু ঘরে বসে থাকা সাধারণ নারীরা সফল হচ্ছেন তা কিন্তু নয়। এমন আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিষমুক্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে মানুষের মাঝে দিতে পারছেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার এই সফল উদ্যোগ আরও অনেকের মাঝে সম্প্রসারিত করতে। ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও গ্রহণে মানুষের শরীর স্বাস্থ্য বিগড়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। সামান্য চেষ্টা, কিছু স্বাস্থ্যসম্মত কর্মযোগ এবং চিরায়ত কৃষি ব্যবস্থাপনার নিরাপত্তার বলয় তৈরি করাই যায়। সত্যিই অভাবনীয় এক অনন্য দৈনন্দিন খাবার উৎপাদনের নিরাপদ আঙিনা।

মানুষকে সবার আগে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হয়। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে গুহাবাসী মানুষ প্রকৃতি যা দান করতো দুহাত ভরে তাই নিত। সেখানে গাছের ফলমূল, কাঁচা মাছ মাংস খাওয়া ছিল আদিম বন্য মানুষদের যাপিত জীবনের আহারের সংস্থান। ক্রমান্বয়ে মানুষ সেই আরাধ্য প্রকৃতিকে জয় করল নিত্যনতুন আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের নানামাত্রিক বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রায়। বিজ্ঞান মানুষকে আধুনিকতার বরমাল্য দিলেও তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় সব মানুষের ক্ষতির মুখোমুখি হতেও সময় নিচ্ছে না। শুধু কি শারীরিক বিপন্নতা? তার সঙ্গে অবিমিশ্র হয়েছে কার্বন নিঃসরণে উষ্ণ প্রকৃতির মারাত্মক দূষণ প্রক্রিয়াও। যা দুনিয়া জুড়ে ‘ধরিত্রী বাঁচাও’ স্লোগানে সংশ্লিষ্টদের সাবধান, সতর্কতায় সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো। যে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শুধু স্বাস্থ্যহানি নয় চারপাশের প্রতিবেশকেও দূষণের আবর্তে ফেলে দিতে দেরি করে না। 
অপরাজিতা প্রতিবেদক

×