যৌতুক প্রথার নির্মমতা
শ্রেণী বিভক্ত সমাজে অর্থ-বিত্ত কিংবা মর্যাদার লড়াই নয় লিঙ্গ বৈষম্য ও নানা মাত্রিকে সংশ্লিষ্টদের বিড়ম্বনার শিকার করে। চিরায়ত গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত অসহনীয় বিধি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া নারীদের যে মাত্রায় শোষণ বঞ্চনার শিকার করে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগেও তার কোন বিরাম বিরতি নেই।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাল্য বিবাহের প্রকোপ আজও অবোধ বালিকাদের জীবন মন কঠিন আবর্তে ঘিরে রেখেছে। গত দুই বছরের করোনাকালেও বাল্য বিবাহের হিড়িকের গণমাধ্যম নিয়তই সংবাদ পরিবহন করে যাচ্ছে। অসহনীয় এই চিত্র উঠে আসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারার ছাত্রীদের ক্রমাগত অনুপস্থিতিতে।
তথ্য-উপাত্তে দৃশ্যমান হয়েছে তাদের সবারই বিয়ে হয়ে যায় এবং সংসার ধর্ম পালনে ব্যস্ত। অপরিণত বিবাহ অত্যাচারে যেমন অকাল মাতৃত্ব তার চেয়েও বেশি যৌতুক প্রথার চরম নিষ্পেষণ। এটাও নতুন কিছু নয়- পুরাকাল থেকে চলে আসা এক অসম নির্মম সামাজিক বিধি। কিন্তু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে যদি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে নামক ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধনকে স্বাগত জানাতে পারতো তাহলে পণপ্রথার অত্যাচারও ক্রমান্বয়ে কমে আসতো।
শুধু গ্রামেগঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলেই নয় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির নগর, শহর, বন্দরেও যৌতুকের বলিতে নৃশংসভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে বহু সংখ্যক নারী। প্রতিবাদের সুযোগ থাকা ছাড়াও আইনী বিধানও দেওয়া আছে অসহায়-দুর্বল নারীদের পক্ষে। সেটা শারীরিক নির্যাতনই হোক কিংবা যৌতুকের দাবিতে নৃশংস আচরণও হতে পারে। কিন্তু বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্যে সেই ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’
কবি গুরুর ‘প্রশ্ন’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা লাইনটি আজও শতবর্ষ পরে কতখানি বাস্তব এবং ক্রিয়াশীল ভাবাই যায় না। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণে আনলেই আরও কিছু দুঃসহ বেদনা সহজেই বিমর্ষ করে দেয়। জমিদারী দেখতে এসে আমাদের বাংলাদেশে ঘুরে বেড়ানোর সুবর্ণ সময়ে তার হাত দিয়ে নতুন এক সম্ভার বাংলা সাহিত্যকে ঐশ্বর্যময় করে তোলে। সেটা কবির অসাধারণ ছোট গল্প।
আঙ্গিক আর বৈশিষ্ট্যে কবির ‘দেনা-পাওনা’ শুধু রবীন্দ্র সৃজনে নয় পুরো বাংলার সাহিত্যাঙ্গনের প্রথম সার্থক ছোটগল্প। যা ১৮৯০ সালে কবি রচনা করেন গ্রাম বাংলার দুঃখ দুর্দশার নির্মম কষাঘাতে। সেটাও কিন্তু পণপ্রথা নিয়ে। যৌতুকের নির্মম শিকারে ঘুরপাক খাওয়া অসহায় কন্যা নিরূপমা এবং তার নির্বিত্ত পিতার যে মর্মান্তিক দুর্দশা- সেটাই গল্পের মূল সারবত্তা। যৌতুকের নিপীড়নে পিষ্ট অসহায় নিরূপমাকে শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের সূচনা কাল। আর একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের চলমান যাত্রা পথ এখনও পণপ্রথার আবর্ত থেকে মুক্ত হতে আরও কতদূর যেতে হবে জানি না।
রবীন্দ্রনাথ দেনা-পাওনার নিষ্ঠুর পরিণতির আখ্যান তুলে ধরতে গিয়ে অন্য মাত্রার জমকালো নজিরও উপস্থাপন করেন। নিরূপমার শেষকৃত্যে শ্বশুর নাকি প্রচুর অর্থব্যয় করেছিলেন। তাতে তাদের কিছু ঋণও নাকি হয়েছিল। গল্পটির শেষ লাইন- ‘উৎসবে- আয়োজনে সত্যিকারের প্রতিমা বিসর্জন তো বটেই।’
১৯১৪ সালে লেখেন ‘অপরিচিতা’ গল্পটি। সেই পণপ্রথার নিষ্ঠুরতম বিধি। কবির লেখনীতে সমাজ অনেকখানি এগিয়ে। নারীরা শিক্ষিত হয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার ক্ষমতাও অর্জন করছে। নায়িকা কল্যাণী শুধু শিক্ষিতাই নন একজন শিক্ষয়িত্রীও বটেন।
সঙ্গত কারণে বিয়ের আসরে বরপক্ষ যখন যৌতুকের জন্য হরেক রকম বাগ্যুদ্ধের অবতারণা করে, সেখানে নববধূর সাজে সালঙ্করা কল্যাণী নিজেই বিয়ের আসর থেকে উঠে যায়। শুধু তাই নয়, বরকেও নাকাল অবস্থায় উঠে আসতে হয়। শুধু কন্যা কল্যাণীর লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্ত মনোবলে। সব ক্ষেত্রে আসলে তা হয়ও না। কারণ চেতনা যদি তার শিক্ষার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিপদ পদে পদে।
বাংলাদেশে এখন নারী শিক্ষা অনেকখানি অবারিত। কর্মজীবী নারীদের সংখ্যাও আর হাতে গোনার অবস্থায় নেই। শুধু শিক্ষকতা নয়, নানা মাত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ পেশায় নারীদের সাবলীল অভিগমন উন্নয়ন খাতকে অনেকখানি এগিয়েও দিচ্ছে। কিন্তু সমাজ সংস্কারের গভীরে জিইয়ে থাকা পুরনো বিধিকে অতিক্রম করার মানসিকতা জাগাতে ব্যর্থ হলে সমস্যা থেকে বের হওয়ার আসলেই কঠিন। কিছুদিন আগে বিভিন্ন সংবাদপত্রে যৌতুকের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হওয়া এক গৃহবধূর মর্মান্তিক চিত্র দুঃসহ এবং অমানবিক।
স্বামী চিকিৎসক এবং শ্বশুর মশাই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। যার কারণে নির্যাতিত গৃহবধূ কোন মামলাও করতে পারছিল না। স্বামী যৌতুকের দাবিতে তার অপারেশনের কাঁচি-ছুরি দিয়ে স্ত্রীর হাত কাটাকুটি করতেও পিছপা হয়নি। তবে শেষমেশ নির্যাতিত গৃহবধূটি মামলা করতে পারলেও শেষ রক্ষা সেভাবে হয়নি।
কারণ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা শ্বশুর মহাশয় পুত্রবধূর দাবি মেনে নিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করলেও পরবর্তীতে অত্যাচার আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ। যৌতুকের দাবিতে এমন অনেক অঘটন গ্রামেগঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হরহামেশাই ক্রিয়াশীল। অনেক কিছু জনসমক্ষের আড়ালেই থেকে যায়।
অপরাজিতা প্রতিবেদক