ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে বজ্রকন্যার স্বপ্ন 

রুমেল খান

প্রকাশিত: ২০:০৭, ৩০ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ২০:৪২, ৩০ আগস্ট ২০২২

নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে বজ্রকন্যার স্বপ্ন 

কিক বক্সিং, সেলফ ডিফেন্স এবং রেপ এ্যান্ড প্রিভেনশনের ইনন্সট্রাকটর হিসেবে নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে কাজ করতে চান তামান্না

কথার বিষ তরল হজম করার সময় নেই আর/সময় হয়েছে নারী এবার রুখে দাঁড়াবার/সহ্য করার সময় হলো শেষ পিষ্ঠে প্রহারের পর প্রহার/সময় হয়েছে নারী তোমারও কয়েক ঘা দেবার।চিত্রা শর্মার কবিতার এই পংক্তিমালাগুলো হয়তো তিনি পড়েননি। কিন্তু তিনি যা ভাবেন, যা করতে চান ... সেটা যেন পুরোপুরি মিলে যায় এই কবিতার সঙ্গে!

নারী মানেই দুর্বল, কোমল স্বভাবের, অবলা-এমন ধারণা পোষণকারী লোকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কিন্তু এমনটা মনে করেন না একজন নারী। শুধু মনেই করেই ক্ষান্ত নন, তিনি এটা প্রমাণও করতে চান। এজন্য একদা হাতে পরেছিলেন চুড়ির বদলে বক্সিং গ্লাভস্। এখন গ্লাভস্ আপাতত তুলে রেখে অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদের সহায়তা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছেন যিনি, তিনি তামান্না হক। এই তরুণীর স্বপ্নটা এমনই বড়।

একসময় বক্সিং খেললেও এখন এই খেলাটি নানা কারণে আর খেলছেন না। তাই বলে বসে নেই তিনি। কিক বক্সিং এবং সেলফ ডিফেন্সের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এছাড়া রেপ এ্যান্ড প্রিভেনশনের ইনন্সট্রাকটর। বর্তমানে দুটো জিমনেশিয়ামে (উত্তরা এবং মগরাজারে) কাজ করছেন ইন্সট্রাক্টর হিসেবে। সম্প্রতি কুংফুর ওপর ট্রেনিং নেয়া শুরু করেছেন। আশা করছেন সময়মতো ব্ল্যাকবেল্ট পেয়ে যাবেন।

২০২০ সালে কিক বক্সিং এবং সেলফ ডিফেন্সের কোর্স করেন তামান্না। রেপ এ্যান্ড প্রিভেনশনের কোর্স করেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের এক ব্রিটিশ-বাঙালি ইন্সট্রাক্টর আলী আকবরের (কারাতেতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন) কাছে। একটা বাদে এই কোর্সগুলো করতে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে তামান্নাকে। একেকটা কোর্সের খরচ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে! তামান্নার জানামতে বাংলাদেশের খুব কম মেয়েই এসব কোর্স করেছেন।

প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন তামান্না। উত্তরার জিমে সপ্তাহে দিন, মগবাজারেরটায় সপ্তাহে দিন করে। থেকে ঘণ্টা সময়সীমা। দুই জিম মিলিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ। অনার্সে ফ্যাশন ডিজাইনিং এবং বিউটিফিকেশনের ওপরও কোর্স করেছেন। ফলে ফ্যাশনের সবকিছুই নখদর্পণে। এজন্য সাজগোজ করতে হলে অন্যদের মতো বিউটি পার্লারে যেতে হয় না তাকে। ভবিষ্যতে বিউটি পার্লার খোলারও সুপ্ত বাসনা আছে তার।

বক্সারকন্যা তামান্না দেশের অসহায়-দুস্থ নারীদের নিয়ে কাজ করার জন্য বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হবার লোভনীয় প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন

ছোটবেলা থেকেই টিভিতে রেসলিং খুব পছন্দ করতেন তামান্না। বক্সিংও দেখতেন। তবে কিছু নিয়ম-কানুন শৃংখলার জন্য বক্সিং বেশি ভাল লেগে যায়। বাংলাদেশে মেয়েদের বক্সিং শুরু ২০১২-১৩ সালে। আর তামান্নার বক্সিংও শুরু ঠিক ওই সময়টাতেই। যদিও শুরুতেই তাকে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে পরিচিতজনদের কাছ থেকে। বিসিআইএসআর সাবেক সহকারী সচিব বাবা নুরুল হকও রাজী ছিলেন না। সেসব পাত্তা দেননি তামান্না। যাহোক, কিছু টুর্নামেন্ট খেলেন। প্রথমটাতেই রানারআপ হন। নিয়ে তামান্নার ভাষ্য, ‘সে সময় যে ওয়েট হাইট ( ফুট ইঞ্চি) নিয়ে খেলি, তখন আমার ওয়েট-হাইটের কোন মেয়েকে পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে কম ওয়েট হাইটের মেয়েদের সঙ্গে আমাকে খেলতে হয়েছে। আমাকে ট্রেনিং করতে হয়েছে ছেলেদের সঙ্গে! তখন এই খেলায় মেয়েদের কোন ভবিষ্যত দেখতে পাইনি। এখনও পাই না। কারণ এই খেলায় প্রাইজমানি নেই, অর্থ আয় নেই, ইনজুরি হলে ক্যারিয়ার অনিশ্চিত, নিজের ভাড়ায় ভেন্যুতে যাওয়া, নিজের টাকায় ফিটনেস ফুড মেইনটেন করতে হয় ... সবই আমার খরচ! মেয়েদের বক্সিং ক্যারিয়ার ডেভেলপ করতে হলে ব্যাপারে বক্সিং ফেডারেশনকে অনেক তৎপর হতে হবে।

বক্সিং খেলে যখন সময় অপচয় হচ্ছিল, তখন তামান্না সিদ্ধান্ত নেন-যেহেতু ফাইট করতে ভালবাসেন, ফাইট নিয়ে আরেকটু ভেরিয়েশন জানা দরকার। যেটা দিয়ে নিজে পরবর্তীতে কাউকে শেখাতে পারবেন। এভাবেই তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে।

জিমে যাদের ব্যায়াম শেখান, তামান্না সবসময়ই তাদের আত্মরক্ষা শেখার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেন। বিশেষ করে মেয়েদের, ‘একটা রেপিস্ট একটা মেয়েকে আক্রমণ করলে কেন সে তাকে প্রতিহত করতে পারবে না? কাজেই সেলফ ডিফেন্সটা জানা একটা মেয়ের জন্য খুবই দরকার। তা না হলে কখন দুর্ঘটনা ঘটে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না।

সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের ভয়ংকর সব অত্যাচার-হুমকি মোকাবেলা করে সেলফ ডিফেন্সে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে তামান্নার

জিমেই আপাতত তাদের আত্মরক্ষার বিভিন্ন কলাকৌশল শেখাচ্ছেন তামান্না, তাও সেটা বিনামূল্যে। ভবিষ্যতে একটা সেন্টার খুলে সেখানে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজটা করার স্বপ্ন-পরিকল্পনা আছে তার।

গত ফেব্রুয়ারিতে তামান্না নিজেও এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। একদল সন্ত্রাসী কচুক্ষেত ক্যান্টনমেন্টে তামান্নাদের নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট (বিল্ডার্সের মাধ্যমে) থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে এসে তামান্না তার ছোট বোন তারজিনা হক তিশাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়, অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে, ইভটিজিং করে, বাসার গেট ভেঙ্গে ফেলে, পানির ট্যাংকির ভেতরে ডাস্টবিনের ময়লা ঢেলে দেয়। থানায় সাহায্য চেয়েও কোন সহায়তা পাননি তামান্না। পাশেই ছিল কমিশনারের বাসা। কিন্তু কেউ তামান্নাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। এখনও সেই সন্ত্রাসীদের ভয়ংকর সব অত্যাচার-হুমকি মোকাবেলা করছেন তামান্না। সেদিনের ঘটনার পর থেকে সেলফ ডিফেন্সের ওপর আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে তার। 

দুটি জিমে চাকরি করার পাশাপাশি পার্সোনাল ট্রেনিংও করান তামান্না। সবমিলিয়ে মাসে যে অর্থ উপার্জন করেন, তাতে বেশ ভালোভাবেই চলে যায় তার। বাবা-মা-বোনকেও প্রায়ই কিনে দেন এটা-সেটা। বন্ধুদের ট্রিটও দেন। গত চার বছর ধরে এভাবেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন তিনি। তাকে দেখে অনেক নারীই বলেছেন, ‘আপু, তুমি আমাদের প্রেরণা!’ ব্যাপারে নিজ পরিবারের পূর্ণ সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছেন তামান্না। কলিগ-ক্লাসমেটরাও তাকে নিয়ে গর্বিত। কুংফুর ওপর যে কোর্স করছেন, সেটা শেষ করে নিয়ে কাজ শুরু করলে তখন নিশ্চিতভাবেই তার আয় আরও বাড়বে।   

নারী অধিকার নিয়ে ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে কাজ করতে চান তামান্না। নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে। কিন্তু কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। এজন্য উইমেন রাইটস ইউএন বাংলাদেশ ... এসব সংস্থার সঙ্গে জড়িত হতে চান। তাহলে স্বপ্নপূরণ করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

মামা কানাডা থাকেন। তিনি প্রায়ই তামান্নাকে সেখানে স্থায়ীভাবে গিয়ে থাকতে বলেন। বন্ধুরাও তাই বলে। ইচ্ছে করলেই সেটা করতে পারেন তামান্না। কিন্তু দেশকে ভালবাসেন তামান্না, ‘এই দেশে আমার করার মতো অনেক কাজ আছে ... নারী নির্যাতন, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, রেপ ভিকটিম নিয়ে। এগুলো শেষ করতে হবে আমার।

এগুলোর মধ্যে রেপ ভিকটিম নিয়ে কাজ করাকে অগ্রাধিকার মনে করেন তামান্না, ‘আমার কাজ হবে যারা রেপ ভিকটিম, দীর্ঘসময় ট্রমায় থাকাকালীন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, তাদের আত্মহত্যা করা থেকে ফিরিয়ে আনা। এগুলো অনেক কঠিন কাজ। এসব নিয়েই তো কোর্স করেছি।

বজ্রমুষ্ঠির বজ্রকন্যা তামান্নার নারীদের সহায়তা করার এই মহৎ স্বপ্ন খুব দ্রুতই বাস্তবায়িত হোক, এটাই সবার নিগুঢ় প্রত্যাশা।

×