
ছবি: সংগৃহীত।
ছোটবেলায় ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির উঠোনে বা বারান্দায় রাখা তুলসী গাছের পাতা ছিঁড়ে মুখে দিয়েছি অনেকেই। হয়তো না জেনে, শুধু শুনে—"তুলসী ভালো"। সময় বদলেছে, শহর ঘন হয়েছে, উঠোন হারিয়েছে, কিন্তু তুলসীর উপকারিতা আর আধ্যাত্মিক মর্যাদা হারায়নি। আজও গ্রামের বাড়ির অনেকখানি শুদ্ধতা জড়িয়ে আছে একটি তুলসী গাছে।
বাংলা সংস্কৃতিতে তুলসী শুধু একটি গাছ নয়, এটি একপ্রকার বিশ্বাসের প্রতীক।বিশেষ করে হিন্দু ধর্মে তুলসী গাছের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুলসীকে দেবী রূপে পূজা করা হয়। বাড়ির উঠোনে তুলসী তলা বানিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো, তুলসী মঞ্চে ফুল দিয়ে পূজা করা—এসব যেন একটি হিন্দু বাড়ির পবিত্রতার প্রতীক। তুলসীকে বলা হয় "বিষ্ণুপ্রিয়া"। বিশ্বাস করা হয়, যেসব ঘরে তুলসী গাছ থাকে, সেখানকার পরিবেশ থাকে শুদ্ধ, অশুভভ শক্তি প্রবেশ করতে পারে না। কোনো উৎসবে, পূজায় বা আচার-অনুষ্ঠানে তুলসীপাতা অনিবার্য উপাদান।তবে তুলসী গাছের উপস্থিতি শুধুই আধ্যাত্মিক নয়, বাস্তবিক দিক দিয়েও উপকারী।
তুলসীপাতায় ইউজেনল (Eugenol), লিনালুল, কারভাকরল, মেথাইলচ্যাভিকল, উরসোলিক অ্যাসিডসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা জীবাণুনাশক, ব্যথানাশক ও রোগপ্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে।
ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি,বাড়ির ছোট বাচ্চা অথবা বড়দের একটু ঠান্ডা লাগলেও বলা হয়ে থাকে-'তুলসি খাও'।তুলসীপাতা দিয়ে তৈরি চা বা রস সর্দি-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি ও কফজনিত সমস্যায় উপকারী। এটি শ্বাসতন্ত্র পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।প্রতিদিন সকালে খালি পেটে কয়েকটি তুলসীপাতা খেলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়। তুলসীর পাতা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ইনসুলিন নিঃসরণকে প্রভাবিত করে।
এছাড়াও তুলসীর গন্ধ স্নায়ুকে প্রশান্ত করে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এটি কর্টিসল হরমোন কমিয়ে মানসিক চাপ হ্রাস করে। ব্রণ, একজিমা, র্যাশ বা মাথার খুশকির জন্য তুলসীপাতা পেস্ট বা রস উপকারী। এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণে সমৃদ্ধ। কিছু প্রাথমিক গবেষণায় তুলসীর উপাদানগুলো ক্যানসার সেল গ্রোথ ধীর করতে সাহায্য করতে পারে বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
ভারতের সেন্ট্রাল ড্রাগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (CDRI), ব্যাঙ্গালোরের আইআইএসসি (IISc), এবং আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের (NIH) গবেষণায় তুলসীকে "অ্যাডাপ্টোজেনিক" ভেষজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে—অর্থাৎ এটি শরীরকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে চাপজনিত পরিবেশে। এটি জিনগত কোষকে সুরক্ষা দেয়, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং ডিটক্সিফায়ার হিসেবে কাজ করে।বিশ্বব্যাপী হেলথ ব্র্যান্ডগুলো এখন তুলসীকে প্রিমিয়াম হার্বাল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করছে। তুলসী ইনফিউজড টি, তুলসী ক্যাপসুল, তুলসী সিরাপ, তুলসী অয়েল—সবই এখন বাজারে জনপ্রিয়।
অনেকেই ভাবেন, শহরে থাকলে তুলসী রোপণ করা সম্ভব নয়। অথচ বারান্দায়, জানালার ধারে কিংবা ছাদে একটি মাঝারি টবেও তুলসী চাষ সম্ভব। প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস পানি দিয়ে তুলসী গাছকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এটি যেমন পরিবেশ শুদ্ধ রাখে, তেমন ঘরের বাতাসেও প্রশান্তি এনে দেয়।তুলসী গাছ খুব বেশি যত্ন চায় না। রোদ, হালকা পানি ও সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকলেই এটি বেড়ে ওঠে। এটি মশা তাড়াতে সাহায্য করে এবং অন্যান্য গাছের তুলনায় পোকামাকড় কম ধরে।
তুলসীপাতা শুধু ওষুধ বা পূজার উপাদান নয়, এটি রান্নাঘরেরও বন্ধু। চায়ে মেশালে গন্ধ ও স্বাদে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। ঠাণ্ডা শরবতে তুলসী ও লেবুর সংমিশ্রণ অত্যন্ত উপকারী। অনেকেই তুলসীপাতা দিয়ে তৈরি করেন ‘তুলসী শরবত’ বা ‘তুলসী মধু মিশ্রণ’, যা শরীর পরিষ্কার রাখে ও ত্বক উজ্জ্বল করে।
তুলসী এখন শুধু ভারত বা বাংলাদেশের গাছ নয়। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হার্বাল প্ল্যান্ট। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই তুলসী চাষ হচ্ছে। আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ও প্রাকৃতিক চিকিৎসার আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে তুলসী একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। বিশেষ করে মহামারি করোনা সময়েও তুলসীভিত্তিক প্রতিরোধক ওষুধ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
আমাদের ঘরের এক পাশে যদি তুলসী গাছ থাকে, তাহলে সেটা শুধু শারীরিক সুস্থতা নয়, মানসিক প্রশান্তিও দেবে। এটি যেমন পরিশুদ্ধ করে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, তেমনি মনকেও পরিশুদ্ধ করে। ছোট্ট একটি গাছ থেকে যে উপকার মিলতে পারে, তা বড় বড় ওষুধেও পাওয়া যায় না। তুলসী রোপণ করা যেমন সহজ, তেমনি এটি এক প্রকার আত্মিক চর্চাও বটে।তুলসী শুধুই একটি গাছ নয়—এটি হাজার বছরের আস্থা, বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধন। আধুনিক জীবনে যখন নানা রোগে নাজেহাল মানবদেহ, তখন তুলসীর মতো প্রাকৃতিক পথ্য আমাদের হয়ে উঠতে পারে সহজ, সস্তা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এক নির্ভরতা। এখন সময় ফিরে তাকানোর—আমাদের উঠোন, বারান্দা বা ছাদে যেন আবার জায়গা করে নেয় এই সবুজ চিকিৎসক। তুলসী ফিরে আসুক আমাদের জীবনচর্চায়, আস্থায়, প্রতিদিনের ব্যবহারে।
নুসরাত