ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

আমিনা বেওয়ার দুঃখগাথা

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ৩১ জুলাই ২০২৫

আমিনা বেওয়ার দুঃখগাথা

রংপুর জেলা সদরের মমিনপুর ইউনিয়নের মাস্টারপাড়া গ্রাম। এ গ্রামের ৭০ বছর বয়সের বিধবা বৃদ্ধ আমিনা বেওয়া। ২০ বছর ধরে মাথায় ডালি নিয়ে পথ চলেন। এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন বাদাম ও গরম গরম সিঙারা। আশ্চর্য মনে হলেও আমিনা বেওয়ার জীবন সংগ্রামের বাস্তব গল্পটা এমনি। স্বামী মারা গেছেন। তার চেয়ে আরও কঠিন কষ্টটি হলো স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমিনা বেওয়ার দুই ছেলে মৃত্যুবরণ করেছিল। 
এর পরেও বুকে পাথর বেঁধে মনোবল নিয়ে রোদ বৃষ্টিতেও বৃদ্ধার পথ থমকে যায়নি। বৃদ্ধ আমিনা বলেন চলি ফিরি খাওয়া নাগে। অর্থাৎ জীবন যতদিন আছে ততদিন এভাবেই চলতে হবে, এভাবে কর্ম করে খেতে হবে। হাটবাজার থেকে কাঁচাবাদাম কিনে বাড়িতে ভেজে নেন। আবার কখনো গ্রামের মনিরপুর মিলেরপাড়ের প্রদীপ কুমারের হোটেল থেকে  শিঙাড়া এনে বিক্রি করেন। আমিনা জানান, গ্রামে যখন কারও দোকান হয়নি ওই সময় থেকে তেল, লবণ, সাবান, মসলা, শুঁটকিসহ বিভিন্ন পণ্য বাড়িতে এনে বিক্রি করতেন। এখন পুঁজি নেই, মালামালও নেই। তাই তাঁর বাড়িতে কেউ আসে না এখন আর।
বয়সের কারণে সপ্তাহে দু-তিন দিনের বেশি বের হতে পারেন না আমিনা বেওয়া। মাসে পাঁচ কেজি বাদামও বিক্রি হয় না। তবে প্রদীপের হোটেলের শিঙাড়া নিয়ে গেলে ২০০-২৫০ টাকার মতো বিক্রি হয়।
বৃদ্ধ আমিনার গল্পে তার আক্ষেপটা অন্যরকম। সংসার জীবনে সুখের ঠিকানার চেয়ে কষ্টটা সন্তানদের নিয়ে। কারণ মা হিসেবে সন্তানদের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্টটা অনেক বেশি।
আমিনা বেওয়া নিজের জীবনের নানা দুঃখগাথা তুলে ধরে বলেন তার চার ছেলে, তিন মেয়ে। বড় ছেলে কুদ্দুস মিয়া হৃদরোগে ও ছোট ছেলে এজারুলের মূত্রনালিতে সমস্যায় ৫-৬ বছর আগে মারা গেছেন। দুই ছেলের মৃত্যুর কয়েক মাস পর তার স্বামী মামুদ মিয়াও মারা যান। এক ছেলে ফেরদৌস ঢাকায় দিনমজুরি করে। তার স্ত্রী পঙ্গু হয়ে গেছে। বউয়ের চিকিৎসা করতেই ওর কাহিল অবস্থা। আরেক ছেলে বাদশা গ্রামের মমিনপুর মিলের পাড়ে চা-পানের দোকান করে বউ বাচ্চা নিয়ে খায়। আমিনা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দুই ঈদ এলে ভিজিএফের ১০ কেজি করে চাল পান। তবে বিধবা ভাতা বা দুস্থ মাতার কার্ড পেয়েছেন কিনা সেটি বলতে পারেননি তিনি। 
বৃদ্ধ আমিনার বিষয়ে ওই এলাকার বামনপাড়ার গৃহবধূ লিপি বেগম বলেন, এই বয়সেও পরিশ্রম করছেন আমিনা বেওয়া। এমন কর্মঠ নারী গ্রামে আর নেই। আর হোটেল ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমার বলেন, আমিনা অনেক পরিশ্রমী। বয়স হয়ে গেছে, তারপরও বাড়িতে বসে থাকেন না। কিছুদিন আগে রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল। দুই মাসের মধ্যেই আবার কাজে বের হয়েছেন। 
ছেলে বাদশা বললেন ছোট ভাই ঢাকা থেকে মাকে হাত খরচের কিছু টাকা দেয়। আর মা আমার কাজেই থাকেন। মা ঘরে বসে থাকতে চান না। মা উল্টো বলেন ‘যত দিন চলতে পারব, তত দিন কাজ করে খাব। চলতে না পারলে কেউ একমুঠো ভাত দিলে চলবে।’
আমিনা বেওয়ার গল্পকে ছেলে বাদশা তার বৃদ্ধ মাকে নিজের কাছে রেখেছেন। মা তার সাহস ও ভরসা....যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জনপ্রিয় ওই গানের কথায় 
আঁধারের ভ্রুকুটিতে ভয় নাই,
মাগো, তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই,
যদি এ পথ চলিতে কাঁটা বিঁধে পায়
হাসিমুখে সে বেদনা সবো... কত দূর আর কত দূর বল মা...।

প্যানেল/মো.

×