ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

রোমাঞ্চকর কুদুমগুহা

প্রকাশিত: ১২:৪১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রোমাঞ্চকর কুদুমগুহা

মানুষ অনেক কিছুই ভুলে গেলেও ছাত্রজীবনের উত্তাল দিনগুলোর কথা ভুলতে পারে না। জীবনের শেষ বয়সেও সুযোগ পেলে হারিয়ে যাওয়া ছাত্রজীবনের মধুর স্মৃতিগুলো রোমন্থ করে, একপ্রকার তৃপ্তি অনুভব করে সুখ খুঁজে নেয়। তেমনি ৯০ দশকে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের বন্ধুদের নিয়ে গড়া, ওপেন ফ্রেন্ডস গ্রুপের ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঘুরতে গিয়েছিলাম কক্সবাজার জেলার নানান জায়গায়। নিজ নিজ শহর থেকে দূরে কোথাও, দুটো দিনের জন্য ঘোরাঘুরির ফাঁকে ফেলে আসা ছাত্রত্ব ফিরে পাবার ব্যর্থ প্রয়াস। সারারাত যানজট ঠেলেঠুলে বেলা প্রায় ১১টায় কক্সবাজার গাড়ি পৌঁছায়। দেরি হবার কারণে সকালটা বিফলে যায়। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাই কলেজে উঠে সবাই জুমা পড়ার প্রস্তুতি নেই। অতঃপর ভোজনপর্ব শেষে দোস্তদাররা, সুগন্ধা সমুদ্র সৈকতে হাছা-মিছা চাপাবাজিতে মেতে উঠি। মনের দিক থেকে ফিরে যাই সেই কলেজ জীবনে। সন্ধ্যার পর পর চলে বার-বি-কিউ। ইতোমধ্যে তৎকালীন রুডগুলোতে খেতাব পাওয়া জিন্না এসেও হাজির। রাত নয়টা বাজতেই রাজু টানিয়ে দেয় তাঁবু। শুনব আজ সাঈদের গলায় সেই ময়না তো আজ অন্য কারো/আমার কেহ না। কিন্তু সে লাপাত্তা। কি আর করা, আমরা যারা ছিলাম তারা- একেবারে খারাপ সিঙ্গার না। সেই সঙ্গে নাচতেও কম জানি না। হা হা হা। সবাই কমবেশী পুরনো দিনের স্মৃতি হাতরে বেড়াই। একটা সময় ছিল যখন হদাই রাত জেগে, বাদামতলী রকেট ঘাটে আড্ডা জমাতাম। গানের ভাষায় লিখতে হয়- সেইসব দিনগুলো আজ আর নেই/কোথায় হারিয়ে গেলো/ কলেজ অডিটরিয়াম, বাহাদুর শাহ পার্ক আর রকেটে ঘাটের/ মধুর সেই আড্ডা মারার দিনরাত। সৈকতপারের আড্ডা চলতে চলতে রাত প্রায় দুটা। হুট করেই সবুর আর আনিসের মধ্যে লেগে যায় তুমুল হট্টগোল। পরক্ষণেই আবার মিলমহব্বত। এ যেন সেই হারিয়ে যাওয়া ছাত্রজীবন। ওদের হাঙ্গামায় ভাতের ক্ষুদায় পেটে টান লাগে, জম্পেশ আড্ডায় ছেঁদ টেনে যাই দাওয়াত ভাত ঘর নামক রেস্টুরেন্টে। পরদিন সকালে কলাতলীর বাসিন্দা ভুট্টো ভাইর চান্দের গাড়িতে ছুটে চলি মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে টেকনাফ। নির্দিষ্ট আসন সংখ্যার চাইতে জনসংখ্যা ছিল বেশি। প্রথমে বসা নিয়ে শঙ্কিত হলেও মেরিন ড্রাইভ সড়কের দু’পাশের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, গাড়ির সিটে তেমন দেয়নি বসতে। বরং অনেকেই আফসোস করেছে কেন পারতেছে না ঠিকমতো দাঁড়িয়ে, লোহার খাঁচার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করতে। ছাদবিহীন নীল আসমান দেখতে পারা, চাঁন্দের গাড়ি শাঁশাঁ করে চলে। একপাশে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আরেক পাশে পাহাড়। বাতাসের ঝাপটা চৈত্রের খড়তাপকেও ম্লান করে দেয়। যেতে যেতে জালিয়াপালং ব্রেক। প্রস্তাবাধীন ইফতি সী প্যালেসে খানিকটা সময় বিরতি। ওপেন ফ্রেন্ডস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন হবে এখান হতেই। প্রথমেই প্যালেসের স্বত্বাধিকারী হামিদুর রহমান রহমান হামিদ ভাইর পূর্ব নির্দেশে কেয়ারটেকার আমাদের কচি ডাবের পানি পান করায়। এরপর উদ্বোধনী কার্যক্রম। সেই সঙ্গে বিগত ২৬ বছরের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য পর্ব শেষে আবারও ছুটলাম টেকনাফের পথে। কেউ একজন প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুর গান ছাড়ল আমার কি দোষ/আমি তো মানুষ/শুধু স্মৃতিগুলো রেখ।/ কখনও যদি আমায় মনে পড়ে। গানের লিরিকগুলো ভ্রমণের সঙ্গে বেশ মানিয়ে গেল। পৃথিবীর বৃহত্তম মেরিন ড্রাইভ সড়কে গাড়ি চলতে চলতে একেবারে প্রায় শেষ প্রান্তে। এ পাশটায় পাহাড় আর সমুদ্রের রয়েছে অপূর্ব মিতালি। সাগরের নীলাভ পানি আর পাহাড়ের হাতছানি, মাঝে বয়ে যাওয়া ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ। সব মিলিয়ে অসাধারণ সৌন্দর্যের এক নজরকাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ। এ পাশটার ন্যাড়া পাহাড়গুলোর আকৃতিও বেশ অদ্ভুত। গাড়ি থেকে নেমে ছুটে যাই সৈকতে। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়ে দু’পায়ে। মাছ ধরার সাম্পানগুলোর বাঁশের আগায়, রংবেরঙের পতাকা আকৃতির কাপড়- দখিনা বাতাসে পতপত করে উড়ে। পুরো সৈকতজুড়ে পিনপতন নীরবতা। আমরা হেঁটে বেড়াই। জনৈক মাঝির জীবন সংগ্রামের গল্প শুনি। পাশেই দাঁড় করিয়ে দেই বৈমানিক জামিলকে। একজন আকাশ আরেকজন পানি পথের চালক। অথচ দু’জনের জীবনযাপনে কি অদ্ভুত গরমিল। এবার যাই চলে যাই হোয়াইকং। শ্যামলাপুর বাজার পেরিয়ে অবারিত সবুজের ক্যানভাসের ভিড়ে, সরু সড়কে চান্দের গাড়ি ছুটে চলছে হেলেদুলে হাঁড়িখোলার দিকে। চলতে চলতে টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য পিছনে ফেলেই কুদুমগুহা যাওয়ার ফটকে গাড়ি ব্রেক। বন বিভাগের বেশ কিছু সাইনবোর্ড ঝুলছে কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। ইট বিছানো পথে গাড়ি কিছু দূর গেল। এবার গাড়ি ছেড়ে পা’য়ে হাঁটা শুরু। বন্ধুদের শুনালাম হাতি, অজগরের কাহিনী। জানিয়ে দিলাম হাতি সামনে পড়লে সালাম দিয়ে পরিচয় জানাবে। শুধু ভয়ে পিলে চমকালো হালিমের। এছাড়া সবাই যেন প্রস্তুত রয়েছে বন্যপ্রাণী আক্রমণের লাইভ দেখার প্রত্যাশায়। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই পেয়ে গেলাম কয়েকজন বন প্রহরী। তাদের একজনকে সঙ্গী করে ছুটলাম। শুরু হলো রোমাঞ্চকর ট্রেইল। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই কুদুম গুহা মুখের দেখা পেলাম। আমিত পুরাই থ’। অথচ ৮/৯ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন হাইকিং-ট্র্যাকিং ছিল প্রায় ঘণ্টাদেড়েক। সঙ্গে পুলিশ স্কটও ছিল। পর্যটনবান্ধব করায় আজ আর নেই সেই এ্যাডভেঞ্জার ফ্লিংস। দিনে দিনে সব কিছুই কেমন যেন কৃত্রিমতায় গ্রাস করে নিচ্ছে। এবার গুহার ভিতরে প্রবেশের পালা। ১৬জনের মধ্যে মাত্র ৪জন আমি, নাদিম, রনি ও সবুর পানিতে নেমে গেলাম। বাকিরা হা করে তাকিয়ে রইল। বুঝে নিলাম এরা দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের দামাল নয়। তাই বেশি জোর করলাম না। শুরুতেই কমর পানি। ধীরে ধীরে গুহার ভিতর এগিয়ে যাচ্ছি। অন্ধকার অনেকটাই গিলে খেল। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দিলাম। মাঝামাঝি যাওয়ার পর বুক পর্যন্ত পানি। শত শত চামচিকা আর বাঁদুরের উদ্ভট আওয়াজ। গুহার দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ মিটার। প্রথম দিকে প্রস্থ প্রায় ১২ফুট হলেও শেষের দিকে সম্ভবত ৪/৫ ফিট হবে। অনেকটাই ভুতুড়ে পরিবেশ। এবারের প্রাপ্তি ছিল গুহার শেষ প্রান্ত প্রর্যন্ত পৌঁছানো। শুনেছি অজগরের প্রিয় খাবার নাকি চামচিকা। দুঃখের বিষয় অজগরের দেখা মেলেনি। বেশ কিছুটা সময় গুহার ভিতর কাটিয়ে বেশ ফুরফুরা মেজাজে বের হয়ে আসলাম। কুদুম গুহা মূলত বালুমাটির তৈরি প্রাকৃতিক গুহা। এর ভিতরে থাকা জমানো পানি বেশ স্বচ্ছ টলটলে। গুহার প্রাচীর হতে অনবরত পানি চুয়ে পড়ে। গুগোল সূত্রে জেনেছি, গুহার ভিতর ছোট ছোট আকৃতির অজগর, বিরল প্রজাতির প্রভাতি বাদুর ও নানান প্রকারের মাছের বিচরণ রয়েছে। গুহার প্রবেশ মুখে মাকড়সা রয়েছে। সবমিলিয়ে কুদুম গুহাটি বেশ রোমাঞ্চকর। ফিরতি পথে বন্ধুরা হাসতে হাসতে বলল কত কি শুনাইলি কতই না দেখাইলি ভয়, তার তো কিছুই দেখলাম না। এই জগতে মানুষের ওপর যেমন ভাল কিছু নেই ঠিক তেমনি ক্ষতিকারক প্রাণী হিসেবেও জুড়ি মেলা ভার। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন গুহার প্রবেশমুখেই মাকড়শার বিশাল জাল আর অজগরের খোলস দেখতে পেয়েছিলাম। আর এবার সব শ্রেণীর অবাধ আগমনের লক্ষ্যে, পর্যটনবান্ধব কার্যক্রম চালাতে গিয়েই হয়তো- আসল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলীনের উপক্রম। রতন-মান্নান তো হাতির মল দেখেই বেশ তৃপ্তি পেল। আর পাবেই বা না কেন! আফ্রিকা মহাদেশে এই হাতির মল হতেই দুনিয়ার সবচাইতে দামী কফি বানানো হয়। ইস খাবারের কথা ভাবতেই পেট বাবাজি জানান দিল, সেই সকালে খেয়েছিলাম নাস্তা। বেলা বাজে এখন প্রায় পাঁচটা। যাই খেয়ে নেই আগে। শ্যামলাপুর বাজারের এক হোটেলে, সাগরের সুরমা মাছ দিয়ে গরম গরম ভাত খেলাম সাবাই পেটপুরে। একটা সময় ছিল যখন এই বাজারের নাম শুনলেই, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কারণে ভয়ে দেহ-মনে জেগে উঠত শিহরণ। কোথাও ঘুরতে গেলে বিন্দুমাত্র বন্যপ্রাণীর জন্য ভয় লাগে না কিন্তু মানুষরূপী দু’পায়া জন্তুদের হিং¯্রতা মাথায় রাখতে হয় ঠিকই। শ্যামলাপুর বাজারে আতঙ্কের সেই দিন আর নেই। যে কেউই এখন খাবেন দাবেন নিশ্চিন্ত মনে। যাই এবার গেম রিজার্ভ ফরেস্টের গর্জন বাগান। সেখানে রয়েছে শত শত বছরের পুরনো সব দিগন্ত ছোঁয়া গর্জন বৃক্ষ। আজ থাক সেই গল্প। তুলে রাখলাম প্রাকৃতিক গর্জনের কাহিনী, আগামী কোন এক সংখ্যার জন্য। যাবেন কিভাবে : ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলীসহ দূরপাল্লার বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড হতে কক্সবাজার। সেখান হতে সিএনজি, চাঁদের গাড়ি কিংবা মাইক্রোতে চড়ে মেরিন ড্রাইভ ঘুরে হোয়াক্যংয়ের কুদুম গুহা। খরচপাতি : ঢাকা-কক্সবাজার বিভিন্ন পরিবহন অনুযায়ী প্রতি আসন ৮০০ টাকা হতে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। কটেজ/রিসোর্ট ভাড়া ৪জনের রুম প্রতি ২০০০ টাকা হতে ১২০০০ হাজার টাকার ওপরেও পাওয়া যাবে। কক্স হতে ঝিপ/মাইক্রো সারা দিনের জন্য ৭ হাজার হতে ১৫ হাজার টাকা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রতিটা পর্যটন এলাকায় সিজন ভেদে খরচপাতির তারতম্য ঘটে। ছবির ছৈয়াল ‘ওপেন ফ্রেন্ডস গ্রুপ’
×