যৌন হয়রানি কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে একজন নারীর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। কারণ এ সমাজে খুব কমসংখ্যক নারীই রয়েছেন, যারা জীবনে একবারও যৌন হয়রানির শিকার হননি। অথচ দুঃখজনকভাবে খুব কমসংখ্যকই আছেন যারা এর প্রতিবাদ করেছেন অথবা করতে পেরেছেন। প্রতিবাদ করতে না পারার কারণ হয়তো যিনি হয়রানি করছেন, তিনি বাড়িরই কেউ বা আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, প্রতিবেশী অথবা পরিচিত কেউ। অথবা লজ্জা বা সঙ্কোচের কারণে বলা থেকে না বলাটাই ভাল বলে মনে হয়।
অপ্রিয় হলেও সত্য, অপরাধ যখন যৌনতাকেন্দ্রিক হয়, তখন দুঃখজনকভাবে অপরাধীর চেয়ে অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিকেই বেশি লজ্জা, সঙ্কোচ এবং দোষারোপের মধ্যে পড়তে হয়। কিন্তু এ ধারণাটি পুরনো; এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটা ব্যাপার আমরা ভুলে যাই, যিনি হয়রানি করছেন, তিনি কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন যে আপনি তার পরিবারেরই কেউ অথবা পরিচিতদের মধ্যে একজন; তাহলে আপনি কেন তা মনে রাখবেন? লজ্জা তার, যিনি অপরাধ করছেন; দোষী তিনি, যিনি হয়রানি করছেন। নারীর পোশাক, অবস্থান, কর্মকা- কিছুই এ ধরনের হয়রানির জন্য দায়ী নয়। এ বিষয়টি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা অপরিহার্য। সুতরাং প্রতিবাদ করতে হবে, অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, যৌন হয়রানি দেশের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী দ-নীয় অপরাধ।
প্রতিবাদটি কিভাবে করা যাবে, সেটিও জানা দরকার। যদি যৌন হয়রানি আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা কর্মক্ষেত্রে হয়, তাহলে সে প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানি প্রতিরোধক কমিটি বরাবর অভিযোগ করা যেতে পারে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে একটি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এই কমিটি বর্তমান। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, যিনি হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং যিনি হয়রানি করছেন, দু’জনই ওই প্রতিষ্ঠানের অংশ।
নির্যাতনকারী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিতার তুলনায় উচ্চপদস্থ হয়ে থাকে। তাই নিজের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনতে গেলে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ যোগাড় করতে হবে। প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেয়া যেতে পারে। অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং, স্ক্রিনশট, কল রেকর্ডার সহায়তা করতে পারে। কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে সচেতন থাকতে হবে। প্রথম যেদিন মনে হবে আপনার প্রতি হওয়া কাজটি হয়রানিমূলক, সে মুহূর্তে মৌখিক প্রতিবাদ করা জরুরী। যদি কোন কারণে মৌখিক প্রতিবাদ করতে না পারেন, তাহলে অন্তত যত দ্রুত সম্ভব হয়রানিমূলক কাজটি কোনভাবে রেকর্ড করার চেষ্টা করবেন, যা পরবর্তী সময়ে অভিযোগটি প্রমাণ করার জন্য সহায়ক হতে পারে।
এখন আসি পাবলিক প্লেস প্রসঙ্গে। পাবলিক প্লেস-এ যৌন হয়রানির শিকার হলে দুইভাবে অভিযোগ করা যেতে পারে। একটি হলো মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ। আপনি যদি দ-বিধি আইনের ধারা ৫০৯, ৩৫৪ অথবা ২৯৪-এর অধীনে সংঘটিত কোন অপরাধের শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে অভিযোগ করতে পারবেন কারণ যৌন হয়রানি সংক্রান্ত এই ধারাগুলো মোবাইল কোর্টের অধিক্ষেত্রভুক্ত। ধারাগুলো সমন্বয় করে বলছি : যদি কোন ব্যক্তি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদার অভিপ্রায়ে কোন মন্তব্য, শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে, কোন নারীর শালীনতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে আক্রমণ ও তার প্রতি অপরাধমূলক বল প্রয়োগ করে তাহলে মোবাইল কোর্ট বরাবর অভিযোগ করা যেতে পারে। এ ধারাগুলোর অধীনে যদিও সব ধরনের যৌন হয়রানি অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে বেশিরভাগই এর আওতাভুক্ত। যদি যৌন হয়রানির ঘটনাটি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে তাহলে মোবাইল কোর্টের শরণাপন্ন হওয়া শ্রেয়।
এবারে আসা যাক, কীভাবে মোবাইল কোর্টের কাছে আপনার অভিযোগটি দাখিল করা যাবে। প্রথমে কম্পিউটারের ব্রাউজিং অপশনে বপড়ঁৎঃ.মড়া.নফ-এই ঠিকানায় যাবেন। একটি ফরম স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখা যাবে। ফরমটিতে নাম, মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ইমেইল, ঠিকানা এবং অভিযোগের বিবরণ লিখে জেলা, উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশন বাছাই করে অভিযোগটি পাঠাতে হবে। অনেকের মনে সংশয় থাকে, অভিযোগকারীর তথ্য গোপন থাকবে কিনা। সে সুযোগ রয়েছে। মোবাইল কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে ‘সচরাচর জিজ্ঞাসা’ বাটনে ক্লিক করলে দেখতে পাবেন, এখানে অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি হলো, অভিযোগকারীর গোপনীয়তা নিশ্চিত হবে কিনা? সেখানে গোপনীয়তা চেয়ে দাখিলকৃত কোন নাগরিক অভিযোগ শুধু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার স্বতন্ত্র প্রোফাইলে দেখতে পাবেন। এতে অভিযোগকারীর গোপনীয়তা নিশ্চিতভাবে রক্ষা হবে।
কেউ যদি শপিং মল, গণপরিবহন, রাস্তাঘাট ইত্যাদি জায়গায় যৌন হয়রানির শিকার হন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা প্রায় অসম্ভব। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব দ্রুত ঘটনাটি ঘটে যায় এবং অপরাধী দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। অপরাধী সাধারণত অপরিচিত হয় আর এসব ঘটনায় অনেক সময় প্রমাণ রাখাও সম্ভব হয় না। তাই এসব ক্ষেত্রে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশ ডাকা সহজ এবং কার্যকর। ৯৯৯ একটি কার্যকর হেল্পলাইন নম্বর; এতে ফোন করে যে-কোন অপরাধ সম্পর্কে অভিযোগ করা যায়।
আজকাল আমাদের সর্বক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী স্মার্টফোন। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা যখন অমাদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো শেয়ার করি, তখন সচেতন হওয়া জরুরী। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কেউ যদি হয়রানিমূলক কোন আচরণ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মহিলা অধিদফতরের পক্ষ থেকে খোলা ‘ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার ফর ভায়োলেন্স এ্যাগেইনস্ট উইমেন’-এর এর সহায়তা পাওয়া যাবে। এজন্য ১০৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশী সহযোগিতা, আইনগত উপদেশ, অভিযোগ দাখিল ইত্যাদি বিষয়ে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। ন্যাশনাল হেল্পলাইন নম্বর ১০৯-এ ফোন করে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। অথবা র্যাব-এর সাইবার ক্রাইম ইউনিট-এ অভিযোগ করা যেতে পারে (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮)। একটি কথা এখানে বলে রাখা ভাল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে হয়রানিগুলো হয় সেগুলো অমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বুঝে উঠতে পারি না যে কী করা উচিত। সেক্ষেত্রে ‘ইনসাইট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিনামূল্যে আইনগত পরামর্শ প্রদান করে। এর মাধ্যমে খুব দ্রুত আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি এবং অভিযোগ দাখিল করতে পারি। এছাড়াও অভিযোগ করার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হলো ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘উইমেন সাপোর্ট এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন’। এদের চারটি হেল্পলাইন নম্বর হলো : ০১৭৫৫৫৫৬৬৪৪, ০১৭৫৫৫৫৬৬৪৫, ০১৭৩৩২১৯০০৫ ও ০১৭৩৩২১৯০৩০। এর মাধ্যমে কুইক রেসপন্স টিমের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। এই ইউনিট আপনার অভিযোগটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে এবং সহযোগিতা করবে। উল্লেখ্য, এই টিমের সদস্যদের সবাই নারী। সবশেষে বলতে চাই, আইন আছে, আইনের প্রয়োগ জরুরী এবং প্রতিবাদ করা জরুরী। না হলে আইন আমাদের সহায়তা করতে পারবে না।