
ছবি: সংগৃহীত
৩১ মে সকালে পাকিস্তানের চেনাব নদীর প্রবাহ পরিমাপক যন্ত্রগুলো হঠাৎ করেই প্রবাহে বড় রকমের ঘাটতির সংকেত দেয়, যা সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রেক্ষিতে উদ্বেগ তৈরি করে। এপ্রিলের শেষ দিকের একটি অনুরূপ ঘটনার মতো এবারও প্রশ্ন উঠেছে—ভারত কি এত সহজেই পাকিস্তানের পানির সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে?
চেনাব নদী পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীর একটি—অন্য দুটি হলো সিন্ধু ও ঝেলম—যেগুলো ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তির (IWT) আওতায় পাকিস্তানের অংশ হিসেবে নির্ধারিত। সিন্ধু ও ঝেলম নদীর জন্য পাকিস্তানে তারবেলা ও মাংগলা বাঁধের মতো বড় রিজার্ভার থাকলেও চেনাবের জন্য তেমন কোনো বড় জলাধার নেই। এদিকে, ভারতের দখলে থাকা চেনাবের উজানে তিনটি বাঁধ (বাগলিহার, স্যালাল ও দুলহস্তি) রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে সাময়িকভাবে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যদিও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা নয়।
মে মাসের শেষ দিকে মারালায় প্রবাহের যে ব্যাঘাত ঘটেছে, তা সরাসরি ভারতের পূর্বঘোষণাবিহীন জলাধার ধৌতকরণ (ফ্লাশিং) ও পুনরায় জলাধার পূরণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। ২৯ ও ৩০ মে ভারতে বাঁধ থেকে প্রচুর পানি ছাড়ার ফলে হঠাৎ প্রবাহ বেড়ে যায়, এরপর ৩১ মে ও ১ জুন পানি জমাতে শুরু করায় প্রবাহ আবার তীব্রভাবে কমে যায়। তবে সার্বিক পানির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকলেও এই প্রবাহের সময় পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের নিম্নাঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনায় তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই ধরনের প্রবাহের পরিবর্তন শুষ্ক শীতকালীন মাসগুলোতে (নভেম্বর–জানুয়ারি) আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে, যখন স্বাভাবিকভাবেই নদীর পানিপ্রবাহ কমে যায়। সে সময় যদি একই ধরণের ফ্লাশিং ও পূরণের প্রক্রিয়া চালানো হয়, তবে প্রবাহ এক সপ্তাহের মতো সময়ের জন্য কার্যত অচল হয়ে যেতে পারে। যদিও এতে চুক্তিভিত্তিক পানির বরাদ্দ কমবে না, তবে পূর্বঘোষণা ছাড়া ভারত এভাবে ব্যবস্থা নিয়ে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করছে এবং একইসাথে এটিকে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিক্রিয়া হলো, মুখোমুখি সংঘাতের বদলে কৌশলী ও উন্নত পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। ২২০ বিলিয়ন রুপির প্রস্তাবিত চেনাব বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাধ্য। তবে বাস্তবসম্মত, স্বল্পব্যয়ে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে রিয়েল-টাইম টেলিমেট্রি, নমনীয় খাল রোটেশন এবং সমন্বিত জলাধার ব্যবস্থাপনা সহজেই এক মৌসুমেই কার্যকর করা সম্ভব।
চুক্তি অনুযায়ী ভারত তাদের জলাধার ফ্লাশ করতে পারে, তবে তা উচ্চ প্রবাহ মৌসুমে এবং পাকিস্তানকে আগাম জানিয়ে করতে হবে—যা সাম্প্রতিক সময়ে মানা হয়নি। ভারতের গণমাধ্যম এই ঘটনাগুলোকে একপাক্ষিক শক্তি প্রদর্শন হিসেবে প্রচার করছে, যার মাধ্যমে দেশি জনমনে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের প্রতীকী প্রদর্শন ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতাকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে, পাকিস্তানের জল ব্যবস্থাপনায় নয়।
সবশেষে, পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে ভারতের চুক্তি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, তবে এর পাশাপাশি ঘরোয়া প্রস্তুতি এবং দক্ষতা উন্নয়নই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরক্ষা। উন্নত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ও “ফ্লোটিং ওয়ারাবন্দি” পদ্ধতির মাধ্যমে ছোটখাটো প্রবাহ বিঘ্ন সহজেই সামলানো সম্ভব। আতঙ্কের প্রতিক্রিয়া নয়, বরং সচেতন পরিকল্পনাই চেনাবের প্রবাহ নিশ্চিত রাখার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়।
আবির