
ছবিঃ সংগৃহীত
ঝলমলে আলোকসজ্জা, চকচকে পোশাক, বলিউড গান, রাজকীয় খাবার, আর আনন্দমুখর পরিবেশ—একটি 'বিগ ফ্যাট ইন্ডিয়ান ওয়েডিং'-এর এই চেনা দৃশ্যগুলোই এখন ভারতের বড় শহরগুলোর তরুণদের কাছে নতুনভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে পার্থক্য একটাই—এখানে নেই আসল বর-কনে, নেই বিয়ের রীতি-নীতি।
ভারতের দিল্লি, মুম্বাই ও বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে এই 'ফেক ওয়েডিং' বা 'নকল বিয়ে' পার্টি। এটি মূলত এমন একটি টিকিটধারী আয়োজন, যেখানে অতিথিরা বিয়ের পরিবেশ উপভোগ করতে আসেন, কিন্তু বাস্তবে কোনো বিয়ে হয় না।
এই আয়োজনে থাকে সঙ্গীত, নাচ, দোল বাজানো, ঝলমলে লেহেঙ্গা ও কুর্তা-পাঞ্জাবি পরিহিত তরুণ-তরুণীরা, এমনকি বিয়ের সাজানো খাবারের কৌশলও।
দিল্লিতে এমন একটি 'ফেক সঙ্গীত' অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল এক বিশাল ক্লাবে রঙিন আলোর ঝলক, নারী-পুরুষের জমকালো পোশাক, দোল বাজিয়ে সবাইকে নাচের মঞ্চে তোলা, এমনকি টক-ঝাল পানিতে ভরা টক-গোলগাপ্পার সঙ্গে টকিলা পরিবেশনও ছিল।
প্রথমবার এমন আয়োজনে অংশ নেওয়া শিবাঙ্গী সারীন বলেন, “বাস্তব বিয়েতে অনেক চাপ থাকে—পোশাকের নিয়ম, আত্মীয়দের নজর। এখানে শুধু মজা আর স্বাধীনতা।”
টিকিটের দাম ১,৫০০ থেকে শুরু করে ১৫,০০০ রুপি পর্যন্ত হতে পারে। শিবাঙ্গী ও তার বন্ধুরা একজোড়া টিকিটের জন্য ১০,০০০ রুপি খরচ করেন। “মাসে একবার এমন পার্টি হলে, আমি আবারও যাবো,” বলেন তিনি।
দিল্লির এক রেস্তোরাঁ মালিক শরদ মাদান বলেন, “হাসপাতালিটি খাতে নতুনত্বই এখন মূল বিষয়। লাভ ছাড়াও যদি অতিথিরা খুশি হন, তবু আমি আবারও করবো।”
৮ক্লাব ইভেন্টস-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা কৌশল চনানি জানান, প্রবাসী ভারতীয়দের পার্টি আয়োজন দেখে তারা এ ধারণা পেয়েছেন। “বিদেশে থাকা ভারতীয়রা বলিউড মিউজিকে নাচে, ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরে, সেই ভাবনা থেকেই আমাদের আয়োজন।”
তাদের বেঙ্গালুরুর একটি আয়োজনে ২,০০০ জন অংশ নেন এবং পরবর্তীতে দিল্লির অনুষ্ঠানও পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যায়। এখন তারা SOP (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) তৈরি করে অন্য শহরের আয়োজকদের দিয়ে থাকেন—যেখানে আয়োজনে কিভাবে লাভবান হওয়া যায় তার বিস্তারিত দেওয়া থাকে।
অন্যদিকে, বেঙ্গালুরুর স্টার্টআপ 'থার্ড প্লেস' আয়োজন করে একটি 'সোবার সঙ্গীত'—অর্থাৎ, মদ ছাড়া বিয়ের পার্টির আয়োজন। অতিথিদের বর ও কনের দলে ভাগ করে দেওয়া হয় এবং খেলা হয় ‘ধাঁধা’, ‘কে আত্মীয় চেনা যায় স্টেরিওটাইপ দেখে’ এমন নানা রকম গেমস।
আয়োজক অনুরাগ পাণ্ডে বলেন, “সব সময় পানীয় দিয়ে পার্টি জমে না, আমরা চেয়েছিলাম বিয়ের মূল আবেগটাই ফুটিয়ে তুলতে।”
সামাজিক ভাষ্যকার সন্তোষ দেশাই বলেন, “মানুষ এখন উৎসব খুঁজে নিতে চায়। বিয়ে হল সর্বোচ্চ মাত্রার আনন্দ—যা চাপ ছাড়া হলে আরও উপভোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, “মানুষ এখন পুরনো বিয়ের পোশাক পরারও অজুহাত পাচ্ছে।”
ইভেন্ট পরিকল্পক বিজয় অরোরা মনে করেন, এটি একটি ‘ট্রেন্ড’ হলেও এর বাজার তৈরি হলে হসপিটালিটি খাতে বড় রকমের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
ভারতে বিয়ের বাজার ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বলে জানায় বিনিয়োগ উপদেষ্টা সংস্থা Wright Research। তবে বাস্তব বিয়ে হয় বেশিরভাগ শীতকালে—নভেম্বর থেকে মার্চে। জুন-আগস্ট বর্ষাকালকে অফ-সিজন ধরা হয়। ফলে ফাঁকা ভেন্যু, অবসরপ্রাপ্ত ভেন্ডর, আর মানুষের বিনোদনের চাহিদার মাঝে এই 'নকল বিয়ে' ফাঁক পূরণ করতে পারে।
তবে কিছু অতিথির অভিজ্ঞতা ততটা ভালো হয়নি।
বেঙ্গালুরুর ২৩ বছর বয়সী মার্কেটিং পেশাজীবী শৃষ্টি শর্মা বলেন, “আমি ঘর থেকে দূরে থাকি, বিয়ে মিস করি। ভাবছিলাম আনন্দ পাবো, কিন্তু ইভেন্টটা হতাশাজনক।”
তিনি জানান, “শুরুতে EDM চলছিল, দুই ঘণ্টা পর বলিউড গান বাজানো হয়। খাবারে শুধু পিৎজা, ফ্রাইস আর মদ ছিল—ডেজার্টও না! ডেকরেশনও খুব সাদামাটা ছিল।”
সমালোচকরা বলছেন, এটি হয়ত ভারতীয় সংস্কার ও মূল্যবোধকে হালকা করে দেখাতে পারে।
তবে দিল্লির বিদ্ধি কাপুর বলেন, “যদি কাউকে বর-কনে সাজতে বলা হতো তাহলে আপত্তিকর হতো। এখানে তো সবাই মজা করতে এসেছেন। এটাকে উৎসবের আনন্দ হিসেবেই দেখা উচিত।”
নোভা