
ছবি: সংগৃহীত
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার নেতারা শান্তি আলোচনায় বসছেন মালয়েশিয়ায়, রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষের চতুর্থ দিনে এসে এমন ঘোষণা দিয়েছে থাই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপের মুখে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪ জন নিহত হয়েছেন, নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি মানুষকে।
থাই প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জিরায়ু হুয়াংসাপ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম উইচায়াচাই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে সোমবার (২৮ জুলাই) ওই আলোচনায় অংশ নেবেন। আনোয়ার এই বৈঠক আহ্বান করেছেন আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের (ASEAN) চলতি বছরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতও এই আলোচনায় অংশ নেবেন বলে জানানো হলেও কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত করা হয়নি।
শনিবার ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল-এ দেওয়া এক বার্তায় জানান, তিনি উভয় দেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে নতুন কোনো বাণিজ্য চুক্তি এগিয়ে নেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেছেন। পরে জানান, দুই পক্ষই যুদ্ধবিরতি আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে।
কম্বোডিয়া ‘তাৎক্ষণিক ও শর্তহীন’ যুদ্ধবিরতির পক্ষে
রবিবার সকালে হুন মানেত বলেন, তার দেশ অবিলম্বে একটি ‘শর্তহীন যুদ্ধবিরতি’ চায়। তিনি বলেন, ট্রাম্প তাকে জানিয়েছেন থাইল্যান্ডও হামলা বন্ধে রাজি হয়েছে। এরপর তিনি তার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রক সোকহোনকে নির্দেশ দিয়েছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে সমন্বয় করে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে এবং থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে।
থাইল্যান্ডও নীতিগতভাবে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি জানিয়েছে। তবে থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কূটনৈতিক সমাধান আসতে হলে কম্বোডিয়ার ‘সততার মনোভাব’ প্রমাণ করতে হবে। ফুমথাম বলেন, দ্রুত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে হবে।
সংঘর্ষের জন্য একে অপরকে দায়ী করছে দুই দেশ
গত বৃহস্পতিবার সীমান্তে একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে পাঁচ থাই সেনা আহত হওয়ার পর হঠাৎ করেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই একে অপরকে দোষারোপ করে আসছে দুই দেশ। উভয় দেশই তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছে এবং থাইল্যান্ড সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
রোববারও সংঘর্ষ থামেনি। থাই সেনাবাহিনীর উপ-মুখপাত্র কর্নেল রিচা সুকসোয়ানোন্ত জানান, রোববার সকালে কম্বোডীয় বাহিনী থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশে ভারী গোলাবর্ষণ চালায়, যার মধ্যে সাধারণ মানুষের বাড়িও ছিল। কম্বোডিয়া প্রাচীন তা মুয়েন থম মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থানে রকেট হামলা চালায়, যেগুলো থাই বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। জবাবে থাই সেনারা দূরপাল্লার কামান দিয়ে প্রতিআক্রমণ চালায়।
রিচা বলেন, ট্রাম্পের মধ্যস্থতা ‘আলাদা বিষয়’, যুদ্ধক্ষেত্রে অভিযান চলবে এবং কেবলমাত্র কম্বোডিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করলেই যুদ্ধবিরতি সম্ভব।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কম্বোডিয়া বারবার মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মৌলিক নীতিমালা লঙ্ঘন করছে, ফলে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।’
অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল মালি সোচেতা থাই বাহিনীকে আগ্রাসনের জন্য দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, রোববার ভোরে থাই সেনারা কামান হামলার পর কয়েকটি অঞ্চলে ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে বড় ধরনের অভিযান চালায়, যা শান্তি আলোচনার প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করছে।
৩৪ জন নিহত, লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত
থাইল্যান্ড রোববার আরও এক সেনার মৃত্যুর খবর জানিয়েছে, এ নিয়ে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১-এ, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক। কম্বোডিয়ার পক্ষ থেকে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। থাইল্যান্ডে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজারের বেশি মানুষকে, আর কম্বোডিয়ার তিনটি প্রদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। সীমান্ত এলাকার বহু গ্রাম এখন জনশূন্য, বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-হাসপাতাল।
শান্তির প্রত্যাশায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো
থাইল্যান্ডের কপ চোয়েং জেলার এক বাসিন্দা ও এয়ার কন্ডিশনিং প্রযুক্তিবিদ পিচায়ুত সুরাসিত বলেন, ‘সংঘর্ষের খবর শুনে কাজ ছেড়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হই। এখন আশ্রয়কেন্দ্রে বসেই স্ত্রীর সঙ্গে যমজ দুই মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
ভ্যাটিকানে পোপ লিও চতুর্দশ বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ ও সহিংসতার শিকারদের জন্য প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের শিশু ও বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য আমি প্রার্থনা করছি।’
এদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আসিয়ানকে দুই সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যকার শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতা করার আহ্বান জানিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের নিন্দা জানিয়েছে এবং উভয় দেশকে বেসামরিক জনগণের সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে দশকের পর দশক ধরে বিরোধ রয়েছে। তবে অতীতে সংঘর্ষগুলো ছোট পরিসরে ছিল এবং দ্রুত শেষ হয়ে যেত। সর্বশেষ উত্তেজনা শুরু হয় গত মে মাসে, যখন এক কম্বোডীয় সেনা নিহত হন এবং এরপর থেকেই কূটনৈতিক টানাপোড়েন বাড়তে থাকে।
সূত্র: এপি।
রাকিব