চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি চীনের উহাবুন দু’দিনব্যাপী এক নজিরবিহীন অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। দু’দেশের সম্পর্ক সুসংহত করার লক্ষ্যে এই বৈঠকে তারা দুই দেশের জনগণের তথা বিশ্বের কল্যাণে কিভাবে একত্রে কাজ করা যায় তা নিয়ে মত বিনিময় করেন। গত বছর দোকলামে দু’দেশের যুদ্ধংদেহী অবস্থানের পর এই বৈঠককে বিশেষ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।
এই ঘরোয়া শীর্ষ বৈঠকের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াচ্ছে সেটা পরের কথা। এ থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার বেরিয়ে এসেছে তা হলো চীনের প্রেসিডেন্ট অতীতের সমস্ত প্রটোকল ভেঙ্গেচুরে দেশটির পররাষ্ট্র বিষয়কে পরিপূর্ণ রূপে ব্যতিক্রমীভাবে নিজের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন এবং তা করতে গিয়ে বৈদেশিক নীতির যাবতীয় অর্জন ও ঝুঁকির দায়দায়িত্বও নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন যা আগে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটি ভাগাভাগি করে নিত। এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এই যে দেশ, জাতি, রাষ্ট্র ও পার্টির উত্থান এবং পতন শি জিনপিংয়ের সঙ্গে হচ্ছে। পরিবর্তনের এটা হলো একটা দিক মাত্র। অধিক তাৎপর্যমূলক পরিবর্তনটা হলো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নতুন করে নির্ধারণে চীন এখন বৃহত্তর ভূমিকা পালন করতে আন্তর্জাতিক বিরোধগুলোতে মধ্যস্থতায় নেতৃত্ব দিতে এবং বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে চীনের কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদী মডেলকে ঠেলে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিশেষ দূতের মতে শি ড্রকট্রিন চীনের বৈশ্বিক ভূমিকায় এক লক্ষ্য নিয়ে পরিবর্তন আনবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গত তিন দশক দরে চীনের নেতৃত্ব শান্তিপূর্ণ উত্থানকে মূলমন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। শিয়ের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য তা নয়। তার দৃষ্টিভঙ্গি অধিকতর জাতীয়তাবাদী এবং আন্তর্জাতিকভাবে অধিকতর প্রোএ্যাকটিভ চীন গড়ে তোলা তার জন্য চীনা জাতির বিশাল পুনরুজ্জীবন ঘটানো যাতে স্বদেশে জনগণের উন্নতমর জীবন রচিত হবে। তিনি স্বদেশে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) বৈধতা জোরদার করতে চান।
শি জিনপিং বিশ্বাস করেন যে, সুসময়ের একটা বৈশিষ্ট্য হলো প্রবৃদ্ধির উচ্চহার বজায় থাকা। তবে এই সুসময় চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই তিনি তার নিজের ও দলের ওপর অধিকতর অন্তর্জাত বিশ্বাস কায়েম করতে চান। তার সেই ভিশনের একটি অংশ হলো চীনের আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।
চীনের কূটনীতির দীর্ঘদিনের অনুসৃত মৌল নীতিমালা তিনি ইতোমধ্যে বদলে দিয়েছেন। আগের নীতি ছিল আন্তর্জাতিক বিরোরধ হস্তক্ষেপ না করা, বিদেশে সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা না করা। সেই নীতি আর নেই। ইতোমধ্যে জিবুতিতে প্রথমবারের মতো সামরিক ঘাঁটি খুলেছে চীন। আরও ঘাঁটি চালু হওয়ার পথে আছে। যেমন পাকিস্তানের গোয়াদার, সিচেলিস এবং সম্ভবত প্রশান্ত মহাসাগরের তবে উহান বৈঠকের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ভারত চীনকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ এক অঞ্চল এক পথ নীতির মধ্য দিয়ে চীনের আঞ্চলিক প্রভাব গভীরতর হয়ে উঠছে। এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হওয়ার একটা প্ল্যাটফর্মও রচনা করেছে চীনের জন্য। একদিকে এটি চীনকে ভিন্ন ধরনের পরাশক্তি হওয়ার বিকল্প পথ রচনা করেছে এবং অন্যদিকে আমেরিকা ফার্স্ট নামের আগলে সংরক্ষণবাদের বিপরীতে বিশ্বায়নের নতুন প্রবক্তা হিসেবে চীনকে সামনের কাতারে নিয়ে এসেছে। শি জিনপিং এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগের মাধ্যমে মূলত চীনা মডেলকে বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার আরও জোর চেষ্টা চালানোর সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন। গত অক্টোবরে পার্টি কংগ্রেসে শি বলেন, উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ইচ্ছুক অন্যান্য দেশ ও জাতির জন্য চীনা মডেল এক বিকল্প পথ। তিনি মানবজাতির সমস্যা সমাধানে চীনের প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গির সহায়তা দেয়ারও প্রস্তাব করেন।
কেরি ব্রাউন নামে লন্ডনের এক চীন বিশেষজ্ঞ বলেন, চীন বিদেশের কাছে আমেরিকার মতো এক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হতে চায় না। কারণ চীন জানে এর মধ্যে ঝুঁকি আছে। তবে চীন পরাশক্তির মর্যাদা চায় সেখানে তার দৃষ্টিনিবদ্ধ থাকবে সম্পদ ও বাজারের ওপর। অবশ্য ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সঙ্গে চাহিদাও বেড়ে যায়। কারোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নয় পাশ্চাত্যের দশকের পঞ্চশীল নীতির এই স্তম্ভটি এখন বিগত হয়ে গেছে। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে দক্ষিণ সুদান ও মিয়ানমার পর্যন্ত এটা স্পষ্ট। নিজের গভীর অর্থনৈতিক স্বার্থেই চীন এই দেশগুলোতে রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা জোরদার করেছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ আছে। বড় ধরনের স্বার্থ বিপন্ন হলে চীন সেখানে কতদূর পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে পারে সেটাই এখন দেখার ব্যাপার। তবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে ৫ হাজার কোটি ডলারের প্রকল্প নেয়ার পরিকল্পনা চীনের আছে। ভবিষ্যতে চীন পাকিস্তান সম্পর্কে একটা পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পাকিস্তানী অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চীন জড়িত হয়ে পড়বে। এক ধরনের চীনা ঔপনিবেশিকতা সৃষ্টি হবে পাকিস্তানে। আর আফগানিস্তানেও চীনের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়েছে। ¯্রফে অবকাঠামোর যোগদানের থেকে দেশটি তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রাজনেতিক কুশীলবে পরিণত হয়েছে।
ভারত চীনের এক অঞ্চল এক পথ নীতির ঘোরতর সমালোচক অথচ চীনের এই কৌশলটি এশিয়ায় ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। কারণ অর্থের ভাল, কোন বিকল্প না থাকায় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর বিপুল অর্থের প্রয়োজন। পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত গোটা ভূখ-কে শি জিনপিং তার ওয়ান বেস্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় এনে বিদেশে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব গভীরতর করার জন্য অবকাঠামো গড়ে তুলবেন। চীনা নেতাদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা তাইওয়ানকে কোন না কোনভাবে মূল চীনের আওতায় নিয়ে আসা, সেটা করতে পারলে শি জিনপিং যেন প্রভাব ও ভাবমূর্তি মাওকেও ছাড়িয়ে যাবে। চীনের মহা প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করা এবং সেই দেশটির ওপর মার্কিন প্রভাব খর্ব করাই হচ্ছে শি জিনপিংয়ের বর্তমান উদ্যোগের লক্ষ্য। তবে চীন দোকলাম থেকে নাদাখ পর্যন্ত সীমান্ত অবকাঠামো জোরদার করবে তেমনি শ্রীলঙ্কা থেকে মালদ্বীপ পর্যন্ত চীনের ভারত মহাসাগরে যাওয়ার পথও সুগম করার চেষ্টা চলতে থাকবে। শিয়ের এক অঞ্চল এক পথের আরেকটি লক্ষ্য আপাতত সময়ক্ষেপণ করে এক পর্যায়ে আশিয়ানকে বিভক্ত করে ফেলা।
সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে