
ভারতে ইন্টারনেট সেন্সরশিপ নিয়ে শুরু হয়েছে এক নীরব কিন্তু তীব্র সংঘাত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে প্রযুক্তি জগতের আলোচিত চরিত্র ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’-এর।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের সাতারা শহরের পুলিশ এক পুরনো সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ঘিরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত পোস্টটিতে এক ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাকে 'নিষ্ক্রিয়' বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পোস্টটির অনুসারীসংখ্যা ছিল খুবই কম, মাত্র কয়েকশ।
পুলিশ কর্মকর্তা জিতেন্দ্র শাহানে ‘গোপনীয়’ চিহ্নিত এক নোটিশে লিখেন, “এই পোস্ট এবং এর বিষয়বস্তু মারাত্মক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।” সেই নোটিশে ‘এক্স’-এর কাছে পোস্টটি সরানোর অনুরোধ জানানো হয়।
কিন্তু উল্টো ঘটনাই ঘটেছে। ওই পোস্ট এখনো অনলাইনে রয়েছে এবং সেটিই পরিণত হয়েছে একটি বড় আইনি লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। চলতি বছরের মার্চে ‘এক্স’ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলা করে। মামলায় তারা মোদি সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াকে অসাংবিধানিক ও বেআইনি দাবি করে।
২০২৩ সাল থেকে ভারত সরকারের ইন্টারনেট নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের গতি বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, দেশের অসংখ্য সরকারি সংস্থা ও পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি একটি সরকারি ওয়েবসাইটে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট মুছে ফেলার আবেদন করতে পারছেন।
‘এক্স’-এর দাবি, সরকারের এই পদক্ষেপ সংবিধান লঙ্ঘন করছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ। এর ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের সমালোচনা করাও এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে ভারত সরকার আদালতে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছে, তারা শুধুমাত্র অনলাইনে বেআইনি ও ক্ষতিকর কনটেন্টের বিস্তার ঠেকাতেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকারের দাবি, এই নিয়ন্ত্রণের ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে।
সরকার আরও দাবি করেছে, মেটা ও অ্যালফাবেটের মালিকানাধীন গুগলসহ অন্যান্য বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তাদের এই পদক্ষেপে সমর্থন জানাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ইলন মাস্ক নিজেকে ‘মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী’ বলে দাবি করে থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেন্সরশিপ ও কনটেন্ট মুছে ফেলার সরকারি চাপে পড়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ায়ও এমন চাপের মুখে পড়তে হয়েছে।
তবে ভারতের পরিস্থিতি আলাদা। এটি ‘এক্স’-এর সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারীভিত্তির একটি বাজার। তাই কর্ণাটক হাইকোর্টে মাস্কের এই মামলা কেবল সেন্সরশিপ নয়, বরং ভারতের ডিজিটাল স্বাধীনতা ও প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রণ নীতির ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
২০২৩ সালে ইলন মাস্ক বলেছিলেন, “বিশ্বের বড় দেশগুলোর মধ্যে ভারত সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়।” তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী মোদিই তাকে ভারতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এই মামলা কেবল মাস্ক বনাম মোদি সরকার নয়, বরং প্রযুক্তি বনাম রাজনীতির একটি বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। ভারতের মতো উদীয়মান ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যেখানে প্রশ্ন উঠছে, কতটা স্বাধীন হওয়া উচিত ইন্টারনেট? আর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ গ্রহণযোগ্য? কর্ণাটক হাইকোর্টের রায় শুধু ‘এক্স’-এর ভবিষ্যত নয়, বরং ভারতের অনলাইন গণমাধ্যমের ভবিষ্যতকেও নির্ধারণ করে দিতে পারে।
সূত্র: রয়টার্স
আফরোজা